যুগ স্রষ্টা কবি শামসুর রাহমান
২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান। তিনি ২৩শে অক্টোবর ১৯২৯ পৃথিবীর মুখ দেখেন ও ১৭ই আগস্ট ২০০৬ সালে অনন্ত যাত্রায় পা রাখেন। তাঁর ডাক নাম বাচ্চু ও ছদ্মনাম মুজলুম আদিব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন তাঁর যে সব লেখা পত্রিকায় ছাপা হত সে লেখাগুলোতে তিনি তাঁর ছদ্মনাম ‘মুজলুম আদিব’ বলে ব্যবহার করতেন।
শামসুর রাহমান ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। তবে তিনি ১৯৫৩ সালে বি.এ (পাস কোর্স) পাস করেন।
কবিরা সাধারণত জীবদ্দশাতে তেমন খ্যাতিলাভ করতে পারেন না। কিন্তু শামসুর রাহমান জীবনদ্দশাতেই বাংলার প্রধান কবি হিসাবে পদমর্যাদা লাভ করতে পেরেছিলেন। দুই বাংলায় সমান তালে জনপ্রিয় আধুনিক কবি হওয়ার গৌরব অর্জন করে ছিলেন।
তিনি কবি হিসাবে অবির্ভূত হওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যে দুই বাংলায় অন্যতম কবি হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় তাঁর ‘রূপালি স্নান’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে কবি হিসেবে শামসুর রাহমান সুধীজনের দৃষ্টিলাভ করেন ।
তাঁকে নাগরিক কবি বলা হলেও, তবে তাঁর কবিতায় নিসর্গও কম ছিল না । বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তার দুটি কবিতা খুবই জনপ্রিয। ১৯৭৬ সাল থেকে সাহিত্যপ্রকাশ নিয়মিত প্রকাশিত করে চলেছে ‘শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ এবং প্রতিটি সংস্করণেই গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ দুই সংস্করণের অন্তর্র্বতীকালে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন কাব্যগ্রন্থ।
আসলে শামসুর রাহমান একটা যুগের নাম। যে যুগকে কবি কবিতা লিখে শাসন করতেন। বিংশ শতাব্দীর মাঝা মাঝি সময় থেকে তিনি শুরু করেছিলেন । বাংলায় ভালো কবিতা অনেকেই লিখেছেন কিন্তু তাঁরা যুগকে শাসন করতে পারেননি। শামসুর রাহমান করেছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনিই ছিলেন রাজা। তাঁর নিজের কবিতার প্রতি বিশ্বাসটা ছিল প্রবল। জীবনানন্দ দাশ ভালো কবিতা লিখেছিলেন; কিন্তু তাঁর কালের উপরে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নিজের কালের কবিদের তিনি তেমন প্রভাবিত করতে পারেননি। জীবিত জীবনানন্দের চেয়ে মৃত জীবনানন্দ অনেক বেশি শক্তিশালী ও গ্রহণীয়।
শামসুর রাহমান শুরু থেকেই অনেকটা দাপুটে ও শক্তিশালী মেজাজে ছিলেন । ১৯৬০ সালে যখন তাঁর ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তখন থেকে বাংলা কবিতার একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল। এমনকি চল্লিশের আধুনিক কবিরাও তাঁর কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের অধিকাংশ কবি শামসুর রাহমানের ঘরানায় কবিতা লিখতেন। তাঁর পরের কবিদের অনেকে এখনো রাহমানের কালে পড়ে আছেন। তিনি অনেক লিখেছেন, অনেক রকম করে লিখেছেন। তাঁর প্রতিটি কবিতাই অনন্য। কবিতার পাশাপাশি ছড়াতেও তাঁর হাত ছিল অনেক পাকা নান্দনিক।
তাঁর দীর্ঘ (পঞ্চাশোবর্ধ) কবিজীবনে শামসুর রাহমান কবিতার বিষয় ও ভাষায় নিরন্তর পরীক্ষাপ্রবণ ছিলেন। ব্যক্তি জীবনের উত্থান-পতনের মধ্যে কবিতা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী-এ সত্যটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে। তাঁর কবিতার মধ্যে উর্ধগামীতা ও নি¤œগামীতার খোঁজ নিলে একটা সাধারণ সিদ্ধান্তের দেখা মেলে। জাতীয় জীবনের জলবিভাজিকার বৎসর ১৯৭১-এর পূর্বে রচিত পাঁচটি কাব্যে তিনি কবি হিসেবে তাঁর সার্থকতার শীর্ষ পৌঁছেছেন। পরবর্তী তিন দশকের অধিক কালপর্বে কবিতায় তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা এক হিসেবে ষাট। শুধু সংখ্যার হিসেবে তাঁর অবস্থান রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য না হলেও সন্নিকটে। তবে কবিতায় নিয়মিত পালাবদলের বিচারে তিনি পিছিয়ে আছেন। ৭১-পরবর্তী ৬০টি কাব্যের প্রতিটিতেই তিনি কয়েকটি কবিতা উপহার দিয়েছেন যা রসোত্তীর্ণ।
সাংবাদিকতা পেশার সুবাদে তাঁর কবিতায় রয়েছে বিস্তর সাংবাদিকতার উপাদান, কিন্তু সবই তাঁর কবিত্বের রসে জারিত। তাঁর প্রথম পর্বের কবিতায় যে সকল পুনরাবৃত্ত প্রতীক আমরা ব্যবহূত হতে দেখেছি- ঘোড়া, হরিণ, খঞ্জ, খাদ, ভিখিরি- সেগুলো বিদায় নিয়েছে ও তাদের জায়গায় এসেছে নতুন প্রতীক। এর মধ্যে কোনটি যথার্থ প্রতীক, কোনটি শুধুই চিত্রকল্প- এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে। তাঁর কবিতায় শুরু থেকেই চিত্রজয়তার লক্ষণ স্পষ্ট ছিল। ক্রমশই তা স্পষ্টতর হয়েছে। অনেক সময় মনে হয়েছে অতিরিক্ত চিত্রকল্পের ভিড়ে তাঁর কবিতা প্রায়শই ভারাক্রান্ত, তাঁর বক্তব্যকে ছাপিয়ে উঠেছে ছবির পর ছবি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর রচিত ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ চিত্রকল্পের ঔজ্জ্বল্যে, প্রচুরতায় ও জটিলতায় একটি প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা। সমকাল ও সমকালীন ঘটনা কী রহস্যময় পথে কবিতার পরোক্ষতায় ও প্রতীকতায় উতচে যায়, কবিতা কীভাবে দৃশ্যকে আড়াল করে, অব্যক্তকে ব্যক্ত করে, প্রতীকের ঘন অরণ্যে কবির পথ রেখা অনুসরণ কীভাবে একই সঙ্গে উচ্চকিত ও বিমূঢ় করে পাঠককে এবং আরও অনেক প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এ কবিতায়। এ কবিতায় অসুস্থ নৃপতি ও তৃতীয় রাজকুমার এসেছে দেশীয় রূপকথার জগৎ থেকে। কিন্তু দেশীয় রূপকথা বা পুরাণ কাহিনীর মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি কবি। ইউরোপীয় সাহিত্যের ইলেকট্রা, হ্যামলেট, অ্যাগামেমনন, টেলিমেকাস, ইউরোপীয় পুরাণের ইকারুস ডিডেলাস প্রতীকে রূপান্তরিত হয় তাঁর কবিতার উপজীব্য। বর্তমানের মধ্যে অতীতের প্রতিস্থাপনা, এলিয়ট বিষ্ণুদের এ প্রতীক সন্ধানী তৎপরতায় খুব আগ্রহের সঙ্গেই যোগ দিয়েছেন তিনি। যে ঐতিহ্য তাঁর বিশ্বাস যে ঐহিত্য তাঁকে স্পষ্ট করেছে তা সম্মিলিত ত্রিশের কবিদের ঐতিহ্য। আর এ পথেই তিনি আন্তর্জাতিক কবিতার জগতে ছাড়পত্র পেয়েছেন, বোদিলিয়ার, আরাগ নেরুদার জগতে এবং একই সঙ্গে এখানেও বিষ্ণুদেই পথিকৃত মাবিস, পিকাসো, কাত্তিনস্কির তুলি ও রঙের জগতে। অজস্র ধারায় কবিতা রচনার পাশাপাশি শামসুর রাহমান যে অনুবাদ করেছেন, সেগুলিও তাঁর সামগ্রিক কবিকর্মের অংশ।
অনুবাদগুলির মধ্যে ইউজিন ও’ নীলের মার্কোমিলিয়ানস (১৯৬৭), রবার্ট ফ্রস্টের নির্বাচিত কবিতা (১৯৬৮), খাজা ফরিদের কবিতা (১৯৬৯), টেনেসি উইলিয়মের হূদয়ের ঋতু (১৯৭১), জীবনের এক পর্যায়ে বিভিন্ন জনের প্রণোদনায় তিনি করেছিলেন।
কবি শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ই আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা বেজে ৩৫ মিনিটে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী ঢাকাস্থ বনানী কবরস্থানে, নিজ মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান