সম্পত্তির ভাগ
০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৭ এএম
মনু মোল্লা সাহেব মারা যাচ্ছেন। মানে, তিনি আজ কাল -পরশু -তরশু’র মধ্যে মারা যাবেন। যেকোন সময়ে তার মৃত্যু হতে পারে। এজন্য অবশ্য চূড়ান্তভাবে কোনো দিন তারিখ ঠিক করা নেই। তবে তার মৃত্যুর দিনক্ষণটা একমাত্র উপরওয়ালার হাতে। তার শরীরের অবস্থা মোটেই ভালো নয় বলেই লোকজন এসব অনুমান করে থাকে। এতদিন তিনি শহরের এই বাড়ীটাতে প্রায় একাকী বসবাস করতেন বলা চলে। নিকটাত্মীয় কিংবা আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না তার পাশে । শুধু তার একজন প্রিয় ছাত্র তার নিয়মিত দেখাশোনা করতো । আর সঙ্গে ছিল আমেনার মা । সে তাকে তিন বেলা রেঁধে খাওয়াতো। তার ছেলেমেয়েরা সব বিদেশ থাকে। আশেপাশের অন্যান্য দূরাত্মীয় স্বজনরাও কেউ তার কোনো খোঁজখবর নিতো না। এজন্য তিনি কখনো কোনোরকম মনখারাপ করেননি। যেখানে তার নিজের সন্তানরাই খোঁজ নেয়নি, সেখানে তিনি অন্যের উপর অহেতুক রাগ করে নিজের পাপতাপ বাড়াবেন কোন যুক্তিতে। মনুমোল্লা সাহেব নিশ্চিত মারা যাবেন। তার দুটো কিউনিই ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। ডায়ালাইসিস করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। তাই জগত সংসারের পাঠ চুকতে তার সময় বেশি লাগবে না। দেশের অভিজ্ঞ ডাক্তাররা হাসপাতাল থেকে তাকে বিদায় দিয়েছে ক’দিন আগে। তারা বলেই দিয়েছে তার অবস্থা যখন তখন। তার অনেক বিষয়সম্পদ। এই শহরে বিশ কাঠা জমির উপর তার বিশালবড় একটা বিল্ডিং। আশেপাশে আছে আরও একটি দামি প্লট। আর ব্যাংকে কোটি দুয়েক টাকা মওজুত করা রয়েছে। সবমিলিয়ে তিনি একজন ধনী মানুষ। তা সত্ত্বেও তার কোনো স্বজন পরিজন নেই। তার স্ত্রী মারা গেছে অনেক বছর আগে। বড় আশা করে তিনি ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠিয়েছেন আমেরিকায়। তারা পড়ালেখা শেষ করে সেখানেই বিয়েথা করে যে যার মতো স্থায়ী হয়েছে। কেউ আবার বাপের কথা মনে রাখেনি। সেই থেকে তিনি আজও নিঃসঙ্গ আর বড় একাকী।
তিনি খুব তাড়াতাড়ি আর যেকোনো সময় মারা যাচ্ছেন বলে আজ সকাল থেকে তার বাড়িতে লোকজনের সমাগম হয়েছে বেশ। সবাই তার নিকটাত্মীয়। এতদিন যারা তাকে চোখের দেখা দেখতে আসেনি, আজ তারাও এসেছে একবার দেখতে। তার ছাত্র নাজমুল যথেষ্ট সমাদর করেছে এসব লোকজনকে। কাউকে সে না খেয়ে যেতে দেয়নি। স্যারের আদেশ সে পালন করেছে অক্ষরে অক্ষরে । তার দুই ছেলে আর এক মেয়েও এসেছে ঘন্টাখানেক আগে। তারা এসে খুব মায়কান্না করলো কিছুক্ষণ। তারপর মিনমিন করে বিয়য়-সম্পদের কথা তুললো একে একে। আবার বাপের জন্য দরদও প্রকাশ করলো খুব। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বিষয়-সম্পদের ওপর দাবিটাই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠলো একসময়। অভিজ্ঞ প্রোফেসর সাহেবের তা বুঝতে আর বাকি রইলো না। তিনি তাদের লোভ ও লাভের হিসাব কষতে দেখে চোখের জল ফেললেন কয়েক ফোঁটা। তার বেদনাহত মনটা ভেঙ্গে একেবারে চৌচির হয়ে গেল। সন্তানদের কাছে তিনি সম্পত্তি হতে পারেননি।
তারা হয়েছে সম্পদমুখী। কেউ হয়নি সম্পত্তি। তিনি ভেবেছিলেন দেরিতে এলেও হয়তো তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু বিধি বাম! তারা তাদের আদর্শ ও চিন্তা থেকে একবিন্দুও সরে দাঁড়ায়নি। “বড় ছেলে মিজান বললো, বাবা এবার তবে উইলটা করে ফেলুন। বলা তো যায় না আপনার শরীরের যা অবস্থা! কখন কি...।”
প্রোফেসর সাহেব মনু মোল্লা একটু হাসলেন ছেলেমেয়েদের দিকে চেয়ে। তখন তার শরীরে যেন মুত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের কথা শুনে তবু তিনি কষ্ট করে একটু হেসে তারপর বললেন “তোমাদের কি এই বিষয়-সম্পদ না হলে চলবে না?” বড় ছেলে এমন একটা প্রশ্নে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। কিন্তু বাপের কাছে সে ধরা দিবে না। তাই, সে বেশ বঙ্গিমাসরে বলে বসলো,“ না না বাবা । এসবের জন্য আমি আসিনি। আমি শুধু তোমাকে দেখতে এসেছি। আর এসব দিয়ে আমি কি করবো ? সেখানে আমার কতবড় ব্যবসা। আমি শুধু তোমার দু’আ নিতে এসেছি। তোমার একটু স্নেহ চাই।”
ছোট ছেলে ইমরান হাওলার বললো, “ এসব তো আমার কাছে কোনো বিষয়ই নয়। গত মাসে আমি নিউ জার্সিতে দুই কোটি টাকা দামের গাড়ি কিনেছি। আমার একটা বাড়িও আছে সেখানে। কতবড় চাকরি করছি আমি। তুমি কি ভাবছো, তোমার এই সামান্য বিষয়ের জন্য এসেছি? আসলে তা নয় বাবা। তোমাকে দেখতে এসেছি। আর তোমাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি, বাবা। ”
কথাগুলো সে খুব বড়মানুষের মতো আর বঙ্গিমাতে বলেছে। আর পরিবারের সবার ছোট মেয়েটি বললো, “ এই নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। তোমাদের বাড়ি তুমি যা খুশি করগে। এব্যাপারে আমার বলার মতো কোনোকিছু নেই। বাবা, তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার নাতি-নাতনিদের স্কুলের পড়ালেখার ক্ষতি জেনেও এখানে ছুটে এসেছি। শুধু তোমার জন্য, বাবা! শুধু তোমার জন্য।”
তিনি সব শুনে বুঝলেন, এসব ওদের মুখস্ত কথ্ াওরা তার সম্পদের লোভেই আজ একজোট হয়ে এখানে এসেছে। নইলে ওরা আমেরিকা থেকে এসেছে সপ্তাহখানেক আগে। অথচ, তার এখানে এসেছে আজ! সবাই এ কয়েকদিন ব্যস্ত ছিল শ^শুবাড়িতে। সবার কথা শুনে কিছুক্ষন তার যেন দম বন্ধ হয়ে ছিল। জগতে আজকাল এত , এত অভিনয় চলে তা তার বুঝার বাকি ছিল না। পরে অনেক কষ্টে প্রোপেসর মনু মোল্লা একটুখানি উঠে বসতে চাইলেন।
তখনও তার ছাত্র নাজমুল কাছে এগিয়ে এসে তাকে ধরলো। ছেলেমেয়েরা তখন পাশের রুমে বসে অন্য হিসাবনিকাশ কষতে বসেছে। অনেক কষ্টে তিনি একটুখানি বসতে পারলেন। তারপর ধীরেসুস্থে’ সবাইকে কাছে ডাকলেন। আর বললেন, “তোমাদের আমি চিনেছি । তোমরা আমার বড় আদরের সন্তান । তোমাদের আমি ভালো দেখতে চাই। সবসময় তোমরা ভালো থেকো। তোমাদের জন্য রইলো আমার স্নেহ- ভালোবাসা। আজ তোমাদের সামনে আমার সমুদয় সম্পত্তির ব্যাপারে মৃত্যুকালে একটা লিখিত উইল ও ওসিয়ত করে যা”িছ।” এইসময় তার বিশ^স্ত উকিল সাহেব সবকিছু লেখার জন্য নড়েচড়ে বসলেন।
তিনি যাবতীয় স্ট্যাম্প ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে একবারে প্রস্তত হয়েই এসেছেন। প্রোফেসর সাহেব আগের মতো খুব কষ্ট করে বলতে লাগলেন, “আমার সমুদয় সম্পত্তি এই এলাকায় একটা বিশাল মাদ্রাসা এবং মসজিদ গড়ে তোলার জন্য দিয়ে গেলাম। এই শহরে এখন বড়-বড় অনেককিছু আছে। কিন্তু ভালো মানুষের অভাব রয়েছে মনুষেত্বর অভাব রয়েছে ,এই কুরআন মাদ্রাসাতে অনেক কচি-কাঁচা কমলমতি বাচ্চারা পড়ালেখা করে মানুষের মত মানুষ হবে বাবা-মায়েদের সম্মান করবে । আমার সন্তানতুল্য প্রিয় ছাত্র নাজমুল এই কাজটি করবে। পারলে তোমরা তাকে সাহায্য করবে।” প্রোফেসরের পরিচিত উকিল ততক্ষণে সবকিছু লিখিতভাবে তৈরি করে ফেললেন। উইল শুনে ছেলেমেয়েরা আর দাঁড়ায়নি সেখানে। সবাই চলে গেছে দ্রুতপদে। কারও মুখে একটুখনি আলো দেখা যায়নি! সবার মুখে অমবস্যার ছাপ যেন!
প্রোফেসর সেদিন মারা গেলেন ঠিক দুপুর একটায়। তবু তার কোনো সন্তান আসেনি জানাজায়। সবকিছুর তদারকি করছেন নাজমুল। বাড়ি ছেড়ে সব লোক চলে গেছে। শুধু আছে নাজমুল। তাকে এখানে মাদ্রাসা এবং একটা বিশাল সুনিপণ মসজিদ গড়ে তুলতে হবে। আর সে হবে এই মাদ্রাসা এবং মসজিদ এর পরিচালক। উইলে তাই লেখা আছে। তিনদিন পর প্রোফেসরের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হলো। তবু তার ছেলেমেয়েরা আসেনি। প্রোফেসরের বাড়িটা সেই আগের মতোই আছে।
নাজমুল কয়েকদিনের মধ্যে সেখানে টাঙ্গিয়ে দিলো বিশাল একটা সাইনবোর্ড- প্রোফেসর মনু মোল্লা মাদ্রাসা ও মসজিদ। তারপর সে সর্বশক্তি দিয়ে প্রোফেসরের নামে একটা আধুনিক মাদ্রাসা এবং দৃষ্টিনন্দন মসজিদ গড়ে তোলার কাজে লেগে পড়লো। এভাবে মুতে্যুর পরও বেঁচে রইলেন কমলমতি মানুষগড়ার আদর্শ শিক্ষক মনু মোল্লা ।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান