লেখকদের আত্মহত্যার অন্তরালে যত কথা
০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১৯ এএম | আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১৯ এএম
যে কলম কোটি পাঠকের জীবন দান করে সে কলম কেন নিজের জীবনটা নিজেই কেড়ে নেয়! এ প্রশ্ন হাজার বার নিজেকে করেও কোন উত্তর খুঁজে পাইনি। পাইনি খুঁজে এই রহস্যের মূল হোতা। তবে বিশেষজ্ঞ আর তাদের সুইসাইড নোটের স্বীকারোক্তি এই বলে যে চরম বিষন্নতা, মানসিক চাপ, পারিবারিক কলহ আর ব্যর্থতাই দায়ী। আর স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম ১৭ শতকে তার ‘আত্মহত্যা’ বিষয়ক প্রবন্ধে যেমনটা লিখেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি কোনো মানুষ কখনোই তার জীবনকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেনা, যতোক্ষণ পর্যন্ত সেই জীবনটা তার কাছে মূল্যবান থাকে।’ লেখকদের অমূল্য জীবন তখনই বোধকরি মূল্যহীন মনে হয় যখন তার হৃদয়ে গভীর শূন্যতা, অতৃপ্ত মন আর হতাশায় ভোগেন। এই হতাশা থেকে বিষন্নতা তারপর সময়ের ব্যবধানে জীবনের কাছে হেরে হয়ে যান আত্মঘাতী। এরই সূত্রে সমালোচকেরা ইতিহাসের প্রথম আত্মহত্যাকারী সাহিত্যিক হিসেবে রোমান দার্শনিক ও নাট্যকার সেনেকা (খ্রিস্টপূর্ব ৪-৬৫ খ্রিস্টাব্দ) ধারণা করেন। ঘটনাচক্রে সেনেকা রোমান সম্রাট নীরোর রোষানলে পড়েন। নীরোকে হত্যার জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যর্থ হলে তাদের মধ্যে তার নাম জড়িয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে সমালোচক-গবেষকরা এই তদন্তে সফল হোন যেখানে তিনি নির্দোষ। ভাগ্যের লিখন সেনেকা খন্ডাতে পারেননি। সম্রাটের নির্দেশে তার আত্মহত্যার কার্যক্রম অত্যন্ত নির্মমভাবে সমাপ্ত হয়। শরীরের রগগুলো কেটে রক্তপাত ঘটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়ায় পয়জন পুশ করেও তা না হলে গরম পানির মধ্যে নিজেকে রেখে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। সেখেনকার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে ‘আগামেম’, দ্য ম্যাডনেস অব হারকিউলিস, দ্য ট্রোজান উইমেন, ঈদিপাস, দ্য ফিনিসিয়ান উইমেন। অন দ্যা শর্টনেস অব লাইফ তার বিখ্যাত গ্রন্থ। কারিন বোয়ে (১৯০০-১৯৪১) যিনি সুইডিশ কবি, ঔপন্যাসিক এবং অনুবাদক। তার লেখার উপজীব্য বিষয় বিয়োগান্তক ও বিষণ্ণতা। বেশিরভাগই কবিতা প্রতীকধর্মী কবিতা । তিনি এস টি এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করে পাঠকমহলে সাড়া জাগিয়েছিলেন। তার উপন্যাসের প্লটে সমকামীতা, ধর্ম, সমসাময়িক যন্ত্রণা ও সংগ্রামী জীবন উঠে এসেছে। বিখ্যাত এই লেখকের লাশ ১৯৪১ সালের এপ্রিলে কোনো এক পাহাড়ের পাদদেশে সনাক্ত হওয়ার পর মেডিক্যাল রিপোর্টে অতিরিক্ত ঘুমের ঔষধ সেবন দেখানো হয়। আসলে তিনি প্রচ- মানসিক চাপে ভুগছিলেন তাই আত্মহত্যার পথ ধরা। মানসিক চাপ তথা বিষন্নতায় ভুগে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১) তিনিও আত্মহত্যা করেছিলেন। দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী, এ্যা ফেয়ারওয়েল টু আর্মস, ফর হোম দ্য বেল টলস নামের এইসব বিখ্যাত সাহিত্য কর্মের জনক বিমান দূর্ঘটনায় পড়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। দিনকে দিন অবনতিতে ঢলে পড়লে নিজের এই অপারগ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে যান তারই ফলে শর্টগানের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। তার সুইসাইড নোটের এই অংশটুকু না তুলে ধরলেই নয় কতটা ব্যতীত,অস্থির ছিল তার মন এটাই তার প্রমাণ ‘What these shock doctors don’t know is about writers„and what they do to them„What is the sense of ruining my head and erasing my memory, which is my capital, and putting me out of business? It was a brilliant cure but we lost the patient.
ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি (১৮৯৩-১৯৩০) রাশিয়ান বিখ্যাত কবি, নাট্যকার ও আবৃত্তিকার। তিনিও রিভালবারে নিজের আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। ব্যক্তিজীবনে সম্পর্কের দোলাচল আর মানসিক বিপর্যয় বিশ্বখ্যাত এই কবিকে অকালে প্রাণত্যাগ দিতে হয়। তবে অনেকের ধারণা রুশ ফিউচারিজমের এই লেখক তার সাহিত্যভাবনার শক্তি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছিলেন। তিনি তার সুইসাইড নোটে অবশ্য কাউকে দায়ী করেননি এবং গুজব না রটানোর কথা বলেও গিয়েছেন। রুশ বিপ্লবের এই অন্যতম মহানায়কের শিল্প ভাবনা কি সত্যিই ঠুনকো নাকি অন্যকিছু পাঠকের মনে ঘুরে ফিরে একই প্রশ্ন। আরো প্রশ্ন উঠে যখন পৃথিবীর পাঠকগণ দেখেন ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস (১৯৬২-২০০৮) যিনি ছিলেন সাহিত্যের অধ্যাপক ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং প্রাবান্ধিক। উত্তরাধুনিক যুগের এই লেখক বিখ্যাত উপন্যাস ওহভরহরঃব ঔবংঃ এর জন্য আমেরিকানদের মাঝে সর্বাধিক পরিচিতি কুড়ান। ফস্টার বিষন্নতায় ভুগছিলেন বহুদিন ধরে। মেডিটেশনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ২০০৮ সালে নিজ রুমে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর পরে তাঁর একটি পা-ুলিপি পাওয়া যায় এবং সেটি দ্য পেল কিং নামে প্রকাশিত হয়। ইউসুনারি কাওবাতা (১৮৯৯-১৯৭২) যিনি জাপানের প্রথম সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী লেখক দ্য ওল্ড ক্যাপিটাল, স্নো কান্ট্রি এবং থাউজেন্ট ক্রেইন্স এর মতো বিশ্বখ্যাত উপন্যাসের স্রষ্টা। জাপানের এই দাপটে লেখক ১৯৭২ সালে গ্যাস টেনে আত্মহত্যা করেন। যদিও তার আত্মহত্যা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। তবুও সমালোচনগণ এটাকে আত্মহত্যার দৃষ্টিতে দেখছেন না। পারিবারিক কলহের জের ধরে উরুগুয়ের বিখ্যাত ছোটগল্পকার হোরাসিও কিরাগো (১৮৭৮-১৯৩৭) আত্মহত্যা করেন। একরকম বলতে গেলে তার পারিবারিক জীবন যেন আত্মহত্যার আঁতুড়ঘর। সৎ বাবা, স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে সবাই আত্মহত্যা করেন।
উয়ান দারিয়েন তার বিশ্বখ্যাত গল্প। আসলে তিনি অসাধারণ পান্ডিত্যসম্পন্ন ব্যক্তি হয়েও আট-দশ জন সাধারণের মতো সংসারী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু জীবনের বিষাদময়তা তা হতে দেয়নি। তিনি সংসারের এই ঝঞ্জাল হতে মুক্তি নিতে সায়ানাইড পান করে জীবনের ইতি টানেন।
এবার নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার গল্প, না গল্প নয় সত্যি। জীবনের প্রতি কতটা অমানবিক হয়ে উঠলে এমনটা ঘটাতে পারে তা সত্যিই ভাববার বিষয় যা মোটেও মেনে নেয়ার নয়। জন বেরিম্যান (১৯১৪-১৯৭২) কবি ও লেখক। ঞযব উৎবধস ঝড়হমং তাঁর প্রধান কবিতা সংকলন, যেখানে রয়েছে ৩৮৫ টি কবিতা। কনফেকশনাল এই কবি ওয়াশিংটন এভিনিউ ব্রিজ থেকে নব্বই ফুট নিচে বরফজমা গরংংরংংরঢ়ঢ়র নদীতে লাফিয়ে পড়ে নিজেকে আত্মাহীন করেন।
আমেরিকান চৌকস কবি হার্ট ক্রেন (১৮৯৯-১৯৩২)
মেক্সিকো উপসাগরে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।
ব্যক্তিজীবনে অবশ্য তিনি অত্যধিক মদ পান করতেন।
তার এই মদ্যপতা বিষন্নতার কারণ ছিল বলে জানা যায়। ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৪২-১৯৪১) ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, কবি ও সাহিত্যিক। টু দ্য লাইটহাউজ, অরলান্ডো তার বিশ্বমাদৃত গ্রন্থ। তিনি ব্যক্তিগতসহ বেশ কিছু কারণে ভীষণভাবে মানসিক পীড়ায় আহত হোন। অসুস্থ হয়ে পড়েন বিষণœতার তাপদাহে। অবশেষে একদিন কোটের পকেটে পাথর ভরে ওউস নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার আগে তিনি তার স্বামীর উদ্দেশ্যে একটি সুইসাইড নোট লিখে যান। সুইসাইড নোট লিখে হান্টার স্টকটোন থমসন-ও (১৯৩৭-২০০৫) আত্মহত্যা করেন। তিনি ছিলেন আমেরিকান সাংবাদিক, কবি ও লেখক । Hell’s Angels: The Strange and Terrible Saga of the Outlaw Motorcycle Gangs লিখে পাঠক মহলে সাড়া ফেলেন। থমসন দুর্বিষহ জীবন হতে মুক্তি নিতে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন। জুকিয়ো মিশিমা (১৯২৫-১৯৭০) জাপানের আরেক শক্তিশালী সাহিত্যিক। তিনি একাধারে কবি, নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক। The Temple of the Golden Pavilion তার বিখ্যাত গ্রন্থ। তিনিও আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
গ্যাস টেনে আত্মহত্যাকারী আরেক কবি অ্যানি সেক্সটন (১৯২৮-১৯৭৪) যিনি ছিলেন সাহিত্যে নোবেলজয়ী লেখক। লিভার অর ডাই গ্রন্থের এই স্রষ্টা চরম মানসিক অস্থিরতা আর পারিবারিক কলহে ভুগেছিলেন বহুসময় অতঃপর জীবনের কাছে হেরে যান, করেন আত্মহত্যা। আর আমেরিকান শক্তিধর কবি ও ঔপন্যাসিক সিলভিয়া প্লাথের (১৯৩২-১৯৬৩) কথা না বললেই নয়। তিনিও একজন কনফেকশনাল কবি। তার The Bell Jar শতাব্দীর সেরা উপন্যাস। শ্রেষ্ঠ কবিতা উধফফু। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ মানসিক রোগে ভুগেছিলেন। তিনি মৃত্যু নিয়ে বেশকিছু উক্তি/ চিঠি লিখে গেছেন। বিশেষ করে স্বামী কবি টেড হিউজের সাথে দাম্পত্য জীবনের বেদনা বিচ্ছেদ তাকে আষ্টেপৃষ্টে বিষন্নতার নির্মম জালে আটকে দিয়েছিল। ওহ্ বরেণ্য এই সাহিত্যিকের কি নৃশংস পরিকল্পিত আত্মহত্যা! ভিজে টাওয়াল চুলোয় জড়িয়ে আগুনে তার মাথা দিয়ে গ্যাস ছেড়ে আত্মহত্যা করেন। এছাড়াও মেরিনা তসভেতেইভা, স্টিফেন জোয়েগ, হ্যারি মার্টিনসনও এ পথে হেঁটেছেন। বিশ্বখ্যাত লেখদের এভাবে পথ ধরে হাঁটতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে উদ্বিগ্নতার সাহিত্যে পাঠকদের আস্থা তথা ভরসাস্থল শোচনীয় হয়ে দাঁড়াবে।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান