বহুমাত্রিক প্রতিভা : ভার্জিনিয়া উল্ফ
১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১০ এএম
বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম অ্যাডলিন ভার্জিনিয়া স্টিফেন (২৫ জানুয়ারি, ১৮৮২) লন্ডনের কেনসিংটনে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা লেসলি স্টিফেন একজন লেখক, সমালোচক ও ইতিহাসবিদ এবং মা জুলিয়া স্টিফেন। তিনি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝ সময়ের লন্ডন লিটারেসি সোসাইটির একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখিকা। ভার্জিনিয়া ছিলেন ব্লুমসবারি সার্কেলের সাহিত্যিক যার মধ্যে বার্ট্র্যান্ড রাসেল, রজার ফ্রাই, ডানক্যান্ট গ্রান্ট, ক্লাইভ বেল এবং তাঁর বোন ভেনেসা বেলও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি মূলত উপন্যাস, ছোট গল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তাঁর রচনার আখ্যানের চরিত্রগুলোতে অভ্যন্তরীণ জীবনকে কেন্দ্র করে একাত্ত্বিক ঘটনা এবং দৈনন্দিন ঘটনাগুলোর উপস্থাপন, মধ্যম ও পরিসমাপ্তির পরিণতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি ১৯৭০ এর নারীবাদী আন্দোলনের প্রতিকী ব্যক্তিত্ব। আসলে, তাঁর বইগুলো সেরার তালিকায় নারীবাদী কাজের জন্য। তারই ফলস্বরূপ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মে, মিসেস ডাল্লাওয়ে (১৯২৫), টু দ্যা লাইটহাউজ (১৯২৭), ওরলান্ডো (১৯২৮) অন্যতম। এ্যা রুম ওয়ান’স ওন (১৯২৯) গ্রন্থের বিখ্যাত উক্তি, নারী যখন ফিকশন লেখে তখন তার একটি কক্ষ আর কিছু অর্থ খুব প্রয়োজন”। এই উক্তি বিশ্ব সাহিত্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ব্রিটিশ কথাসাহিত্যিক ভার্জিনিয়া নারী মুক্তির অগ্রদূত, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার, লিঙ্গবৈষম্য, রাজনৈতিক দর্শন ও সমাজ বিশ্লেষক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য উদ্দেশ্য করে ভার্জিনিয়ার ভাষ্য, যদি নিজস্ব একটা ঘর আর ৫০০ পাউন্ডের নিশ্চয়তা দেয়া হয়, নারীরাও অনেক উন্নতমানের সাহিত্য উপহার দিতে পারবে। জেইন অস্টেন থেকে ব্রন্টি ভগ্নিদ্বয়, জর্জ এলিয়ট ও মেরি কারমাইকেল পর্যন্ত সব লেখিকাই অনেক প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও শেকসপীয়রের স্তরে উন্নীত হতে পারছে না আর্থিকভাবে সামর্থ না থাকার কারনে। আর তাই নারীকে নির্ভর করতে হয় পুরুষের ওপর। আর নারীদের নিচে ফেলে না রাখলে পুরুষরা বড় হবে কি করে- এই মনোভাব বজায় রাখলে নারীদের মুক্তি মিলবে কিভাবে? তদানীন্তন সময়ে ঝাঁঝালো এই প্রশ্ন ব্রিটিশ পুরুষতান্ত্রিক সুশীল সমাজের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। ভার্জিনিয়ার ১৯১২ সালে বিশিষ্ট লেখক ও সম্পাদক লিওনার্ড উলফের সাথে বিয়ে হয়। স্বামীর নামানুসারে তার পরিচিতি ঘটে ভার্জিনিয়া উলফ হিসেবে। ১৯১৭ সালে এই লেখক দম্পতি হোগার্থ প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন যা তৎকালীন সময়ে লন্ডনের অন্যতম বৃহত্তম প্রেস। ভার্জিনিয়া এবং লিওনার্ড শক্তিশালী লেখকদের যেমন টিএস এলিয়ট, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, লরেন্স ভ্যান, ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড এবং রাশিয়ান সাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯১৫ সালে উলফের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ভয়েজ আউট’ প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের গহ্বরে মানুষের কাজের এবং ভাবনার জগতের পার্থক্য দেখানো হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে ভালোবাসার স্বরূপ। তিনি একরকম শৈশব থেকেই হতাশাগ্রস্ত। সৃষ্টিশীলতার সাথে বুদ্ধি ও বিভিন্ন মুড ডিজঅর্ডারের যেমন সম্পর্ক তেমনটাই ছিল যৌবনে তাঁর সাথে সিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার ডিজঅর্ডার। তিনি ডিপোলার ডিজঅর্ডার নামক একটি মানসিক রোগে ভুগেছিলেন। ক্রিয়েটিভ কাজের প্রতি ঝোঁক বাড়তে থাকা ভার্জিনিয়া এর শিকার হোন এবং পারিবারিক মৃত্যু বিয়োগ মেনে না নিতে পারার যন্ত্রণায় তিনি ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিলেন। যদিও এই পরিস্থিতিতে তার বৌদ্ধিক ক্ষমতা হ্রাস পায়নি, তিনি একে একে নিরলসভাবে লিখে গেছেন বিখ্যাত সব উপন্যাস, গল্প। তারই প্রেক্ষিতে মিসেস ডাল্লাওয়ে (১৯২৫) ভার্জিনিয়া উলফের উপন্যাসগুলির মধ্যে প্রথম সমালোচিত প্রশংসা অর্জন করে। এটি পাঠকমহলে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের একটি ক্লাসিক হিসাবে বিবেচিত হয়। মিসেস ডাল্লাওয়ে আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক উপন্যাস। যুদ্ধ ও তার ভয়াবহতা এবং এর ফলাফলের হলাহলে দৃশ্যপট সাজানো হয়েছে আর প্রতিদিনের কল্পনা, উদযাপন এবং ট্র্যাজেডির। এরপর ১৯২৭ সালে লিখেন টু দ্য লাইটহাউজ নামক প্রখাত এক উপন্যাস। এতে তিনি একটি পরিবারের মানুষগুলোর বিপর্যস্ত জীবনের নানা উত্থান পতন তুলে ধরেন। যুদ্ধ পরবর্তী সংকট ও একজন নারীর উপর সামাজিক চাপ প্রয়োগের শঙ্কা দেখান। ভার্জিনিয়া উলফের একমাত্র নাটক ফ্রেশওয়াটার (১৯৩৫) যেটা তিনি তার মায়ের বোন জুলিয়া মার্গারেটের জীবনী দিক তুলে ধরে নিজের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ করেন। তার বায়োগ্রাফি ফ্লাস (১৯৩৩) প্রকাশিত হয় এবং তার শেষ উপন্যাস বিটুউইন দ্যা এ্যাক্টস (১৯৪১) সালে প্রকাশ পায়।
তাঁর আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধগুলোর মধ্যে ২২ হাইড পার্ক (১৯২১), ওল্ড ব্লুমসবারি (১৯২২), এ্যাম আই এ স্নব (১৯৩৬), রেমিনিসেন্স (১৯০৮), এ্যা স্কেচ অব দ্য পাস্ট (১৯৪০) অন্যতম। ভার্জিনিয়া উলফের সমাদৃত কিছু বিখ্যাত উক্তির মধ্যে ‘যদি তারা নিজের অভিজ্ঞতার সাথে লেগে থাকে তবে তারা সর্বদা অনুভব করবে যে তারা যা চায় তা নয়, ভালোবাসার চেয়ে বিরক্তিকর ও অমানবিক কিছুই নেই, তবে একই সাথে এটি সুন্দর এবং প্রয়োজনীয়ও বটে’ অন্যতম। তিনি ভালোবাসাকে বাস্তব জগত অতিক্রম করে কল্প জগতের নানা অলিগলিতে হাঁটিয়েছেন। যিনি ভালোবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মৃত্যু অবধি থেকেছেন। প্রিয় মানুষটির প্রতি কোনো অভিযোগ না রেখে সর্বদা মঙ্গল চেয়েছেন। অবশেষে এই বলেছেন ভালোবাসা একটি মায়া আর তার শেষ চিঠির গভীরতায় এটা স্পষ্ট যে, ‘ভালবাসা একটি মায়া, একটি গল্প যা একটি তার মনে গড়ে তোলে, সর্বদা সচেতন যে এটি সত্য নয়, এবং সে কারণেই তিনি মায়া ধ্বংস না করার জন্য সতর্ক হন।’ সুদীর্ঘসময় হতাশায় ভোগা এই লেখিকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় কোমল হৃদয়ে তীব্র আঘাত হানে। আর জীবনের সাথে, অসুস্থতার সাথে পেরে উঠতে না পারায় আত্মহত্যা করার আগে ভার্জিনিয়া তার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেন যা ইতিহাস খ্যাত সুইসাইড নোটের একটি।
তবে একথা সত্য ভার্জিনিয়া ইচ্ছেপূর্বক জীবন পলাতক নন কেননা তিনি চিঠিতে পরিষ্কার বলেছেন, ‘এবার হয়ত দুজনে মিলেও এ খারাপ সময় পার করা যাবে না।’ আত্মঘাতী এই ট্র্যাজিক হয়ত তার কপালের লিখন ছিল। অবশেষে ১৯৪১ সালে উলফ তার কোটটি পাথরে ভরাট করে নিজেকে ওউস নদীতে ফেলে দেয়। তার লাশ কয়েক সপ্তাহ পরে পাওয়া গেছে। স্বামী লিওনেল কবরস্থিত গলিত দেহাবশেষ সাসেক্সের মংক হাউজের একটি গাছের পাদদেশে সমাহিত করেন।
১৯৭৬ সালে তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় সম্পাদিত গ্রন্থ ‘মোমেন্টস অব বিইং’।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সিলেটে প্রতিদিন উৎপাদন ৪ লাখ, ঘাটতি রয়েছে ২৫ লাখ ডিমের
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রহস্যজনক লুকোচুরি
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বিশাল শোভাযাত্রা করলো সিলেট স্বেচ্ছাসেবক লীগ
নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব দায়িত্ব নিচ্ছেন
জাবিতে নিয়োগ বোর্ড ঘিরে ছাত্রলীগের 'শোডাউন', চাপে ভিসি!
আশুলিয়ায় ২৪ ঘন্টায় ছয় জনের মরদেহ উদ্ধার
ফায়ার সার্ভিস ও আবহাওয়া অধিদপ্তরকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ স্থায়ী কমিটির
বিএনপি তাদের শাসনামলে পাকিস্তানের দালাল হয়ে জনগণকে শোষন ও অত্যাচার করত-আইনমন্ত্রী
সোনালী আঁশ পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে চাই : বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী
আখাউড়ায় শঙ্কায় থাকা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর আকুতি
বসুন্ধরায় নান্দনিক বানিজ্যিক ভবন নির্মাণ করছে জেসিএক্স
প্রিমিয়ার লিগের মৌসুম সেরা খেলোয়াড় ফিল ফোডেন
স্মার্ট দেশ উপহার দিতে নিরন্তর কাজ করছে সরকার : পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী
যে কোন মূল্যে জীবন দিয়ে দেশ বিরোধী অপশক্তিকে মোকাবেলা করবো : নাছিম
দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।
ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন
সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন
যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা
ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার
বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু