'এমন দমবন্ধ ও সব কিছু অবরুদ্ধ করা' পহেলা বৈশাখ কখনও দেখেননি শাওন

Daily Inqilab সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক

১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:১১ পিএম | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:১১ পিএম

প্রয়াত নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী ও বিতর্কিত অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন মন্তব্য করেছেন, এমন দমবন্ধ করা, সব কিছু অবরুদ্ধ করা পহেলা বৈশাখ দেখিনি। কখনও দেখব বলেও আশা করিনি।



আজ সোমবার (১৪ এপ্রিল) পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে তার একটি লেখা প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি ওই মন্তব্য করেন। শাওনের নিবন্ধনটি নিচে তুলে ধরা হলো-



এ বারের পহেলা বৈশাখটা অন্য বারের তুলনায় যেন একবারে আলাদা। প্রতি বছর আমার দেশে যে ভাবে এই উৎসবটা পালিত হত, সে ভাবে আর হবে না, খুবই অপ্রত্যাশিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে বাংলা নববর্ষে ঢাকায় যে শোভাযাত্রা বার হয়, সেটারও নাম বদল হয়েছে। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র সঙ্গেই পরিচিত আমরা। যদিও এ বছর সেটা ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ বলেই পরিচিত হবে। নামবদলের নেপথ্যে যে রাজনীতির ভূমিকা আছে, তা আঁচ করতে পারি। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে নামবদল হলেই যে আনন্দ নষ্ট হবে, সেটা কিন্তু মনে করতাম না। কিন্তু যখনই দেখলাম, প্রতি বছর আমাদের যে শোভাযাত্রা হয় সেটা চারুকলা বিভাগের ছাত্রেরা আয়োজন করে। কিন্তু এ বার ব্যাপারটা ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর মধ্যে সরকারের হস্তক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি। আসলে সংস্কৃতি কিংবা ঐতিহ্য উদ্‌যাপনে সরকারের হস্তক্ষেপ আমরা আশা করি না। সরকারের এই হস্তক্ষেপের কারণে প্রতি বার যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ হয়, সেটা এ বার হবে না বলেই আমার ধারণা। আমি প্রতি বছর সশরীরে শোভযাত্রায় থাকতে না পারলেও অন্তত টেলিভিশনের পর্দায়, কিংবা সমাজমাধ্যমে সবটা দেখতাম। জানি না, এ বার তেমন কিছু হবে কি না! তবে এ বছর উদ্‌যাপন স্বতঃস্ফূর্ত না হলে বিষয়টা একজন বাঙালি হিসেবে ও শিল্পী হিসেবে দুঃখজনক। আমি নিজে শিল্পী। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের শিল্পীজগৎ ও সংস্কৃতিমনস্কদের নিয়ে নিজেই কেমন সন্দিহান হয়ে গিয়েছি।



সংস্কৃতি জগতের বহু নামীদামি মানুষকেই দেখলাম এই পটপরিবর্তনের সঙ্গে নিজেরাও বদলে গিয়েছেন। একটা কথা উল্লেখ করতে হয়। সম্প্রতি আমাদের এখানে মহিলা সমিতিতে ‘শেষের কবিতা’ নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুনলাম, জনতার প্রতিবাদের মুখে নাকি সেটা করা সম্ভব হয়নি। একদল মানুষ যেখানে নাটক মঞ্চায়ন রুখতে তৎপর। সে ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন— আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের অনেকেই আছেন যাঁরা বর্তমান সরকারের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা কেন কিছু দেখছেন না? তাঁরা কি দেখেও না দেখার ভান করছেন? আসলে সব থেকে মনখারাপের জায়গা হল, একজন শিল্পী হয়ে অন্য শিল্পীর জন্য একাত্ম হতে আর দেখছি না। হয়তো বলতে দেওয়া হচ্ছে না। আসলে বলতে গেলে মুখ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। তাই আজকাল আমিও খুব বেশি কিছু বলি না।



এমন দমবন্ধ করা, সব কিছু অবরুদ্ধ করা পহেলা বৈশাখ দেখিনি। কখনও দেখব বলেও আশা করিনি। আসলে ছোটবেলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রমনা বটমূল, ছায়ানটের গান। ছোটবেলায় সব সময় যেতাম সেখানে। ছায়ানটের গান দিয়ে শুরু হত দিন। সকলে মিলে রাস্তায় বেড়াতাম, রংবেরঙের মুখোশ কিনতাম, যে দিকে তাকাতাম সে দিকেই লাল-সাদা। মনে হত গোটা বাংলাদেশটা ঝলমল করছে। তেমন একটা ঝলমলে শহরে পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনটা এমন হয়ে যাবে, সেটা ভাবিনি।



চারপাশে নামবদল নিয়ে এখন নানা কথা শুনছি। তবে এর বীজটা মনে হয় আগে থেকেই রোপণ করা হয়ে গিয়েছিল। আসলে এখন নামের মধ্যেও ধর্ম খুঁজে বার করা হচ্ছে। ‘আনন্দ’ শব্দটার মধ্যেও চাইলে অনেক কিছু খুঁজতে পারেন। আমার ধারণা, একটা বিশেষ শ্রেণিকে তুষ্ট করতেই এই নামবদল। কারণ তাঁরা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটা পছন্দ করে না। তাঁরা অনেক দিন ধরেই চাইছিলেন, এই বদলটা হোক। রাজনৈতিক পটভূমি বদলালে কিছু না কিছু রদবদল হয়ই। কিন্তু আমরা যা ভেবেছিলাম, তার থেকে অনেক বেশি পরিবর্তন হয়েছে।



অনেকেই হয়তো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটা বিভাজন লক্ষ করতে পারবেন। আগে এখানে বাঙালি সত্তা প্রবল পরিমাণে ছিল, কিন্তু এখন অবশ্য একটা বিভাজন খুবই স্পষ্ট।



যদিও এত কিছুর মধ্যে আমি নিজের পরিবার ও কিছু প্রিয় মানুষকে নিয়ে উৎসব উদ্‌যাপন করব। সবটাই বাড়িতে। যে কোনও উৎসবের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে। তবে ইলিশ-পান্তা খাওয়ার পক্ষপাতী নই সে ভাবে। বরং অনেক ধরনের ভর্তা ও দেশীয় মাছ খেতে ভালবাসি। আসলে এই দিনটাতে ঘরটাকেও সে ভাবে সাজাব। নিজের ও ঘরের মধ্যে সেই দেশীয় সাজকেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি।



তবে মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা যে বাঙালিয়ানা দেখে বড় হয়েছি, সেটা হয়তো আমার সন্তানেরা দেখতে পাচ্ছে না। তবে আমার দুই ছেলে অনেকটা বড়। একজনের বয়স ১৮, ছোটটার ১৪ হল। মানুষ হিসেবে ওরাও খুব সচেতন। ওরা বাংলাদেশের ইতিহাস পড়ত। এখন আমি আরও বেশি করে আমাদের দেশের ইতিহাস পড়তে উৎসাহিত করি। ওদের একটা নিজস্ব মনন তৈরি হচ্ছে। আসলে আমি আশা ছাড়িনি। আমার মনে হয়, আমি যে বাংলাদেশ দেখে বড় হয়েছি, তেমন বাঙালিয়ানা আমার সন্তানেরাও আবার দেখতে পাবে। আর চাই, আমার সন্তানেরা যাতে বাঙালির সংস্কৃতির গুরুত্বটা বোঝে।



তবে যে কোনও প্রসঙ্গে একজন কথায় কথায় চলেই আসেন। তিনি হুমায়ূন আহমেদ। অনেকেই প্রশ্ন করেন, এমন সময় তিনি থাকলে তাঁর কেমন লাগত? আমি নিশ্চিত করে উত্তর দিতে পারব না, তাঁর কী অনুভূতি হত। তবে এটা জানি, তিনি প্রবল ভাবে বাঙালি ছিলেন। যাঁরা ওঁর লেখা পড়েছেন, তাঁরা জানেন। তিনি বাঙালির সংস্কৃতি থেকে রান্নাবান্নার কতটা অনুরাগী ছিলেন। একটা কথা হলফ করে বলতে পারি। পরিবর্তিত এই সময়ে যেখানে নাটক মঞ্চস্থ করা বন্ধ হচ্ছে, গান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের উপর বাধা আসছে, সেটা হুমায়ূন আহমেদ পছন্দ করতেন না বলেই ধারণা।



মাঝেমধ্যে হতাশ লাগে। তবে তার পরেও দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ছাড়ি না। ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখি। তবে একটা জিনিস বড্ড ভাবায়। বাংলাদেশে ‘মব সংস্কৃতির’ চল শুরু হয়েছে, যাকে বলা হয় ‘উত্তেজিত জনতা’। তবে এটাও ঠিক, জনতা নিজে নিজে উত্তেজিত হয় না। পিছনে কোনও না কোনও ইন্ধন থাকে। আমি চাই এই ‘মব সংস্কৃতি’ বন্ধ করতে আশু পদক্ষেপ করুক এই সরকার। 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম
প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় নিয়োগ পেলেন মোহাম্মদ সুফিউর রহমান
নসরুল হামিদের ৪ অ্যাপার্টমেন্ট-ফ্ল্যাট ক্রোক ও ৩ গাড়ি জব্দের নির্দেশ
নির্বাচন বিলম্বকারীদের রুখে দেওয়ার শক্তি আমাদের আছে : ফারুক
শেখ হাসিনার বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন ২৪ জুনের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ
আরও
X

আরও পড়ুন

কুষ্টিয়ায় বিদ্যালয়ের গাছে ঝুলছিল নৈশপ্রহরীর মরদেহ

কুষ্টিয়ায় বিদ্যালয়ের গাছে ঝুলছিল নৈশপ্রহরীর মরদেহ

ভারতের ইন্ধনে হাসিনা রেল নিয়ে যে গভীর চক্রান্ত করেছিল!

ভারতের ইন্ধনে হাসিনা রেল নিয়ে যে গভীর চক্রান্ত করেছিল!

অন্ধত্ব রুখতে পারেনি আরশাদ আলীকে করেন সংসারের সব কাজ

অন্ধত্ব রুখতে পারেনি আরশাদ আলীকে করেন সংসারের সব কাজ

দুইশ’র আগেই শেষ বাংলাদেশের ইনিংস

দুইশ’র আগেই শেষ বাংলাদেশের ইনিংস

দীর্ঘ প্রতিক্ষিত বৃষ্টি বরিশালের জনজীবনে স্বস্তি দিলেও মাঠে থাকা ফসল অতিবর্ষণের ঝুকিতে

দীর্ঘ প্রতিক্ষিত বৃষ্টি বরিশালের জনজীবনে স্বস্তি দিলেও মাঠে থাকা ফসল অতিবর্ষণের ঝুকিতে

নিক্সন চৌধুরীর স্ত্রী তারিনের ফ্ল্যাট ক্রোক

নিক্সন চৌধুরীর স্ত্রী তারিনের ফ্ল্যাট ক্রোক

মার্কিন ডলারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে বিশ্ব?

মার্কিন ডলারের ওপর আস্থা হারাচ্ছে বিশ্ব?

বরিশালে ফয়জুল করিমকে মেয়র ঘোঘনার দাবিতে আদালতের সামনে অবস্থান কর্মসূচী

বরিশালে ফয়জুল করিমকে মেয়র ঘোঘনার দাবিতে আদালতের সামনে অবস্থান কর্মসূচী

গণহত্যার বিচার-সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন হবে অতীতের মতো পাতানো : ড. মাসুদ

গণহত্যার বিচার-সংস্কার ব্যতীত নির্বাচন হবে অতীতের মতো পাতানো : ড. মাসুদ

মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম

মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম

ভাঙ্গা থেকে অনলাইন প্রতারক চক্রের ৪ সদস্য  গ্রেপ্তার

ভাঙ্গা থেকে অনলাইন প্রতারক চক্রের ৪ সদস্য গ্রেপ্তার

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী অঙ্গসংগঠনের ১০ জন গ্রেফতার

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী অঙ্গসংগঠনের ১০ জন গ্রেফতার

একমাত্র ঘরটি ভেঙে দিলে আমি যাবো কোথায়--প্রতিবন্ধী নজরুল

একমাত্র ঘরটি ভেঙে দিলে আমি যাবো কোথায়--প্রতিবন্ধী নজরুল

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষার ভবিষ্যৎ ভারতে নিহিত

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষার ভবিষ্যৎ ভারতে নিহিত

প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় নিয়োগ পেলেন  মোহাম্মদ সুফিউর রহমান

প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় নিয়োগ পেলেন মোহাম্মদ সুফিউর রহমান

বেরসিক চোর !

বেরসিক চোর !

মুক্তিযুদ্ধের সময় লুট ও অগ্নিসংযোগকারী এখন মুক্তিযোদ্ধা : মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে অভিযোগ

মুক্তিযুদ্ধের সময় লুট ও অগ্নিসংযোগকারী এখন মুক্তিযোদ্ধা : মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে অভিযোগ

নসরুল হামিদের ৪ অ্যাপার্টমেন্ট-ফ্ল্যাট ক্রোক ও ৩ গাড়ি জব্দের নির্দেশ

নসরুল হামিদের ৪ অ্যাপার্টমেন্ট-ফ্ল্যাট ক্রোক ও ৩ গাড়ি জব্দের নির্দেশ

রাবি প্রেসক্লাবে মাহিন-মিশন নেতৃত্বে নতুন যুগের সূচনা

রাবি প্রেসক্লাবে মাহিন-মিশন নেতৃত্বে নতুন যুগের সূচনা

বিগত নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তা জড়িত ছিল তাদের বিচারের দাবি এনসিপির

বিগত নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তা জড়িত ছিল তাদের বিচারের দাবি এনসিপির