ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

আল-কুরআনে কুরবানির গুরুত্ব

Daily Inqilab ড. মুহাম্মদ আতিকুর রহমান

০৭ জুন ২০২৩, ০৯:১০ পিএম | আপডেট: ০৮ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

কুরবানী মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। কুরআন মাজীদে নামাজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পশু কুরবানীর নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। সৃষ্টির শুরু থেকে প্রত্যেক জাতি কুরবানীর মাধ্যমে মহান আল্লাহর আনুগত্য ও একত্ববাদের প্রকাশ করে আসছে। আল-কুরআনের বিভিন্নস্থানে কুরবানীর আলোচনা বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আল্লাহর জন্য কুরবানীর তাৎপর্য, হযরত আদম (আ.) এর পুত্রদ্বয়ের কুরবানী, হযরত ইবরাহীম (আ.) কর্র্তৃক নিজ পুত্রকে কুরবানীর ঘটনা, হজ্জে কুরবানীর জন্য প্রেরীত চতুষ্পদ পশুর বিশেষ মর্যাদা ও নিরাপত্তা, পশু যবাইয়ের বিধি-বিধান। পশু কুরবানীর বিধান সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানী নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া চতুস্পদ জন্তু যবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে, অতএব তোমাদের আল্লাহত একমাত্র আল্লাহ সুতরাং তারই আজ্ঞাধীন থাক এবং বিনয়ীগণকে সুসংবাদ দাও” (আল-কুরআন, ২২ : ৩৪)। আল-কুরআনে কুরবানীর জন্য নির্ধারিত পশুকে “বাহীমাতুল আন‘আম” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। “বাহীমাতুল আন‘আম” অর্থ বাকশক্তিহীন চতুষ্পদ জন্তু। এর দ্বারা উট, গাভী, বলদ, মহিষ, ছাগল, দুম্বা ইত্যাদি হালাল পশুকে কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
কুরআন মাজীদে হযরত আদম (আ.) এর পুত্রদ্বয়ের কুরবানীর ঘটনা উল্লেখ রয়েছে। তাদের বিবাহ জনিত বিরোধের মিমাংসায় কুরবানী করার সিদ্ধান্ত হয়। হাবীল একটি সুস্থ ও মোটাতাজা দুম্বা উৎসর্গ করে। আর কাবীল তার কিছু সবজি ও শস্য উৎসর্গ করে। আল্লাহ হাবীলের পশু কুরবানীকেই কবুল করন। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, “আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়ে কিছু কুরবানী করেছিল, তখন তাদের একজনের কুরবানী গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের কুরবানী কবুল হয়নি।”(আল-কুরআন, ০৫ : ২৮)

আল্লাহ তা‘আলা স্বপ্নের মাধ্যমে হযরত ইবরাহীম (আ.) কে তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.) কে কুরবানীর নির্দেশনা প্রদান করেন। ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী তাঁর পুত্রকে কুরবানী করার সময় আল্লাহ তা‘আলা বেহেশত থেকে একটি পশু পাঠান। ইসমাঈল (আ.) এর পরিবর্তে ঐ পশু কুরবানী করা হয়। আল-কুরআনে এ পশুকে “বিজিবহীন আযীম” তথা মহান কুরবানী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, “অতঃপর সে (ইসমাঈল (আ.) যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহীম তাকে বললেন, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখলাম, তোমাকে যবাই করছি; এখন তোমার অভিমত কি? তিনি বললেন, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইবরাহীম তাঁকে যবাই করার জন্যে শায়িত করলো। তখন আমি তাঁকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাঁর পরিবর্তে দিলাম যবাই করার জন্যে এক মহান জন্তু।”(আল-কুরআন, ৩৭ : ১০২-১০৭)

হজ্জের অন্যতম বিধান পশু কুরবানী করা। আল-কুরআনে হজ্জে কুরবানী দেওয়ার জন্য পশুর বিশেষ বিশেষ নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর তা হলো “হাদী” ও “বুদন”। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কুরবানীর জন্য যে সকল পশু হেরেম এলাকায় প্রেরণ করা হয়, সে সকল পশুকে “হাদী” বলে। আর হাজীগণ আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী দেওয়ার জন্য যে উট নিয়ে মক্কায় হাজির হন, তাকে “বুদন” বলা হয়ে থাকে।

আল-কুরআনে কুরবানীর পশুদের “আল্লাহর বিশেষ নিদর্শন” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হজ্জ। হজ্জ পরিপূর্ণভাবে আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট স্থান কাবা, আরাফা, মিনা, মুযদালিফায় গমন করতে হয়। ঠিক তেমনিভাবে হজ্জে পশু কুরবানী করাও অন্যতম বিধান। কাবা, আরাফা, মিনা, মুযদালিফার ন্যায় হজ্জের জন্য নির্দিষ্ট পশু উট, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা,গরু ও মহিষও ইসলামের প্রতীক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। হজ্জে কুরবানীর জন্য নির্ধারিত পশুর নিরাপত্তা বিধানে বিশেষ চিহ্নের উল্লেখ রয়েছে। যেমনিভাবে ইহরাম পরিধানের মাধ্যমে হাজীদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তেমনিভাবে হজ্জের সময় কুরবানীর পশুর গলায় “কালাইদ” (মালা, কণ্ঠাভরণ) পরিধানের মাধ্যমে নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, “হে মুমিনগণ! হালাল মনে করো না আল্লাহর নিদর্শনসমূহ এবং সম্মানিত মাস সমূহকে এবং হরমে কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট জন্তুকে এবং ঐসব জন্তুকে, যাদের গলায় কণ্ঠাভরণ রয়েছে এবং ঐসব লোককে, যারা সম্মানিত গৃহ অভিমুখে যাচ্ছে।”(আল-কুরআন, ৫ :২)।

আল-কুরআনে পশু যবাইয়ের বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। উটকে নহর ও অন্যান্য পশুকে যবেহ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পশু যবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম নেওয়া আবশ্যক করা হয়েছে। যবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম তথা “বিসমিল্লাহ” বলার তাৎপর্য হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করা, সৃষ্টিকর্তা ও বিধানদাতা হিসেবে তাঁকে মেনে নেওয়া। যবাইয়ের সময় পশুর হক হচ্ছে, পশুকে অবশ্যই ধারালো বস্তু দ্বারা যবাই করা এবং যতটা সম্ভব কম কষ্ট দেওয়া। এক পশুর সামনে অন্য পশু যবাই দিতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে কুরবানীর পশুর গোস্ত খাওয়ার বিধানও বর্ণনা করা হয়েছে। কুরবানী শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য হলেও এর গোস্ত নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন ও গরীব-মিসকীনদের মাঝে বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কুরবানীর পশুর গোস্ত বিতরণ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে,‘‘এবং কাবার জন্যে উৎসর্গকৃত উটকে আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্যে মঙ্গল রয়েছে সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় তাদের যবাই করার সময় তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। অতঃপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে তোমরা আহার করো এবং আহার করাও যে অভাবী মানুষের কাছে হাত পাতে না ও যে অভাবী মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায়। এমনইভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের জন্যে বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।”(আল-কুরআন, ২২ : ৩৬)

আল-কুরআনে কুরবানীর বিধি-বিধান বর্ণনার মাধ্যমে কুরবানীর পশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ সকল বর্ণনার মাধ্যমে কুরবানীর পশুর প্রতি মানবিক আচরণের যথার্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের লালন-পালন,পরিবহন, বাজারজাত করণ ও যবাইয়ের সময় উত্তম আচরণ করতে হবে। এ সকল পশু কুরবানীর মাধ্যমে মানুষ ইহকালীন কল্যাণের পাশাপাশি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা