প্রশ্ন: কোরবানির পশু যৌতুক নেওয়া কী ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অপরাধ?

Daily Inqilab ইনকিলাব

১২ জুলাই ২০২৩, ০৮:৩৯ পিএম | আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

উত্তর: চলছে পবিত্র হজের মাস। বায়তুল্লাহ শরীফ লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত। কয়েক দিন পর শুরু হয়ে যাবে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। অন্যদিকে জিলহজ্জ মাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎস হলো ঈদুল আজহা। মুসলিম পরিবারে শুরু হয়েছে পবিত্র ঈদুল আজহার তোড়জোড়। ঈদুল আজহার প্রধান কাজ প্রভুপ্রেমে পশু কোরবানি দেওয়া। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে সামর্থবানরা পশু কোরবানি দিবেন। কোরবানি সকলের উপর ওয়াজিব নয়। যে ব্যক্তির উপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব তার উপর কোরবানি ওয়াজিব। অর্থাৎ বার্ষিক চাহিদা পূরণপূর্বক কোরবানির দিনগুলোতে (১০, ১১ ও ১২ই জিলহজ্জ) যার কাছে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা সমান নগদ অর্থ অবশিষ্ট থাকে তার উপর কোরবানি ওয়াজিব। আল্লাহর রাস্তায় পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে নিজের মধ্যে থাকা আমিত্ব, অহংকার ও পশুত্ব বিসর্জন দেওয়ার নামই কোরবানি। কোরবানি একমাত্র মহান আল্লাহর জন্য নিবেদিত। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ)থর নিরেট প্রভুভক্তির উজ্জ্বল উদাহরণ কোরবানি। একমাত্র খোদাভীতি অর্জনের জন্য স্বানন্দে কোরবানি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছে অনেক মুসলিম পরিবারে। খুশির বাধ ভেঙেছে ঘরে ঘরে। আশার প্রহর গুনছে কখন ১০ই জিলহজ্জের সূর্যোদয় হবে।

কিন্তু এ খুশির ছিটেফোঁটাও নেই কিছু পরিবারে। জিলহজ্জ মাস আসতেই মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। যারা এ বছর মেয়ে বিয়ে দিয়েছে তারা ঈদুল আজহার খুশির চেয়ে ঢের চিন্তিত। একদিকে করোনা মহামারির ছোবলে তিমির অন্ধকারে জনজীবন। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির এ পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্ত পরিবারের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। চরম অনিশ্চয়তায় যাচ্ছে দিন। কখন যে স্বস্তির নতুন সূর্য উদিত হবে সবার অজানা। এসব কষ্ট সামান্যতমও রেখাপাত করছে না ছেলেকে নতুন বিয়ে করানো কিছু নির্দয় পিতা-মাতার অন্তরে। তারা দিব্বি খুশির ঢেকুর তুলে বউমাকে সমানে লজ্জা দিয়ে যাচ্ছে; কখন বেয়াই বাড়ি থেকে তাদের ঘরে কোরবানি পশু আসবে? দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে তাগাদা দিচ্ছে বারবার। আরেকটু এডভান্স হয়ে বলছে পশুটা যেন গরুই হয়। ছাগল হলে চলবে না। গরুটা যেন বড় মোটাতাজা হয়। সমাজে যেন মুখ উজ্জ্বল হয় আমাদের। বড়মুখ করে যেন বলতে পারি, এটা আমার বেয়াই বাড়ি থেকে দিয়েছে। এমন সব অন্যায় আবদার করে বসে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন। মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলে বাড়িতে কোরবানি পশু দেওয়া যেন ফরজে আইন! এ সব অন্যায় আবদার রক্ষায় অসহায় পিতা-মাতাকে হতে হয় নিঃস্ব। নিজেদের কোরবানি করার সামর্থ নেই। তারপরও বেয়াই বাড়িতে কোরবানি পশু নেওয়ার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও হতে হচ্ছে ঋণগ্রস্ত। ঋণ না পেলে নিতে হয় সুদের ভিত্তিতে টাকা অথবা এনজিও থেকে কিস্তি! বেয়াই বাড়ির অন্যায় আবদার রক্ষা করতে ভিটা-মাটি হারানোর দৃষ্টান্তও কম নেই। কোরবানি পশু, মৌসুমি ফল, নাস্তা, উত্তম খাবার দেওয়া-নেওয়াকে কেন্দ্র করে ডিভোর্সের ঘটনাও ভূরি ভূরি। সব পরিবার এগুলো চাই তা কিন্তু নয়। অনেকে নিজের মেয়ে সম্মানের দিকে চেয়ে সাগ্রহে দেয়। নিজের সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে সাগ্রহে দেওয়াটাও ভুল। এটা অন্যের জন্য উদাহরণ হয়ে যায়। ঐ বউয়ের বাড়ি থেকে দিতে পারলে, তোমার বাড়ি থেকে কেন দিতে পারবে না বলে দৃষ্টান্ত দেখায় কেউ কেউ। বায়হাকি শরীফের রেওয়াত, আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ্রসর্বাপেক্ষা বরকতময় হলো ঐ বিবাহ, যা কম খরচে সম্পন্ন করা হয়।

নিঃসন্দেহে কোরবানি একটি পবিত্র ইবাদত। ত্যাগের মহান শিক্ষা কোরবানি। লোভী সম্প্রদায়ের বানানো বেয়াই বাড়িতে কোরবানির পশু দেওয়ার রীতি ত্যাগের বিপরীতে ভোগের রাজ্য কায়েমের কুশিক্ষা দেয়। এ অন্যায়, অপরাধ, অনিয়ম সমাজে চলতে চলতে একসময় অপরিহার্য নিয়মে পরিনত হয়ে যাওয়াটা কত বড় অভিশাপ তা একটি নিন্ম ও মধ্যবিত্ত পরিবারই ভালো জানেন। তাদের বোবাকান্না, অসহায় আত্মসমর্পণ যে কারো অন্তরে রেখাপাত করবেই। ইসলামের নীতিমালা অনুযায়ী অবৈধভাবে বা অনির্ধারিত পথে ধন-সম্পদ অর্জন করা চলবে না। এরশাদ হচ্ছে ্রহে মোমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। (সূরা নিসা: ২৯)।

যে মাসে জিহাদের চেয়েও ইবাদত অগ্রগণ্য। যে মাসে যুদ্ধবিগ্রহও হারাম। গরিবের সহায়, এতিমের বন্ধু নবী (সাঃ) যে মাসের প্রথম দশ দিন স্পেশাল ইবাদতের ঘোষণা দিয়েছেন। বেশি বেশি নফল আদায় ও রোজা রাখতে উৎসাহিত করেছেন প্রিয় উম্মতদের। সে মাসে মুসলিম পরিচয়ে শ্বশুরবাড়িকে চাপে ফেলে স্বার্থ হাসিল করা শুধু অমানবিকই নয়; বরং চরম চরম অন্যায়। বাংলাদেশের আইনে এটা নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮০ সালে যৌতুকবিরোধী আইন পাস করেন। বিয়ের নতুন বছর মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কোরবানির পশু দেওয়ার অপরিহার্য রেওয়াজটা একটা অসামাজিকতাকে সামাজিকতা বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা। প্রথম বছর ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে কোরবানির পশু নেওয়া রেওয়াজের নামে একটা নির্ঘাত অসুস্থ সংস্কৃতি। এটা যেমন সুস্থ সংস্কৃতির অংশ নয়, ঠিক তেমনি ইসলামও এ গর্হিত অপরাধকে মারাত্মকভাবে ঘৃণা করেন। কাউকে কষ্ট দিয়ে কিছু আদায় করা। চাপ দিয়ে কিছু নেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জোরপূর্বক অন্যায্য দাবি আদায় করার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। সুরা নিসার ৩০ নং আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ্রআর যে ব্যক্তি সীমা লঙ্ঘন ও জুলুম করে, অচিরেই তাকে আগুনে দগ্ধ করবো। এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সমাজিক রীতি বলে চাপিয়ে দেওয়া এ অপরাধের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলার এখনই মোক্ষম সময়। এ প্রতিবাদে প্রবীণদের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে নতুন প্রজন্মকে। আমরা প্রায় সকলেই এ সমস্যায় জর্জরিত। প্রায় সকলেই ভুক্তভোগী। কেউ লজ্জায় মুখ খুলছে না, কেউ বা আবার ভয়ে। এ সর্বনাশা কুপ্রথার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। মানুষকে বুঝাতে হবে এটা কোন রেওয়াজ নয়; বরং অন্যায়। এটার মাধ্যমে একপক্ষ লাভবান হয় আর অন্য পক্ষ হয় ক্ষতিগ্রস্ত। মসজিদের সম্মানিত খতিবদের এ বিষয়ে জুমার বয়ানে সাধারণ মানুষকে বুঝাতে হবে। যৌতুকের পাশাপাশি বছরজুড়ে মৌসুমি ফল, নাস্তা, কোরবানি পশু নেওয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে পাঠ্যবইয়ে প্রবন্ধ, নিবন্ধ থাকা যুক্তিযুক্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ সব কুপ্রথার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা তৈরি হলে আলোকিত জাতি গঠন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। টিভি চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা, বিভিন্ন সাময়িকীতে এ সামাজিক অভিশাপের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। যৌতুক নামক সামাজিক ব্যাধির প্রতিরোধে জনপ্রতিনিধি, মেম্বার-চেয়ারম্যান, এমপি-মন্ত্রী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর হস্তক্ষেপ সমাজকে আলোর মুখ দেখাতে পারে।

উত্তর দিচ্ছিন: সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, কলামিস্ট ও ইসলামী বক্তা।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রোহিঙ্গাসংকট: সমাধানের পথ খুলুক দ্রুত
মাইজভা-ার শরিফ : ঐশ প্রেক্ষিত
রমজানে খাদ্য গ্রহণে সচেতন হোন
রমজানের রহমত-মাগফিরাত-নাজাতের বানে ভেসে যাক পাপ
আল্লাহ ছাড়া কোন আশ্রয়স্থল নাই
আরও
X

আরও পড়ুন

ভারতে আবাসিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, যেভাবে নাটকীয়ভাবে বেঁচে গেল একটি পরিবার

ভারতে আবাসিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, যেভাবে নাটকীয়ভাবে বেঁচে গেল একটি পরিবার

অবশেষে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন উখিয়ার ১৩ এসএসসি পরীক্ষার্থী

অবশেষে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেন উখিয়ার ১৩ এসএসসি পরীক্ষার্থী

পবিপ্রবি শিক্ষার্থী পানিতে পড়ে আহত হওয়ার পরে চিকিৎসা অবহেলার মৃত্যুর অভিযোগ

পবিপ্রবি শিক্ষার্থী পানিতে পড়ে আহত হওয়ার পরে চিকিৎসা অবহেলার মৃত্যুর অভিযোগ

শেরপুর জেলা উপজেলায় নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

শেরপুর জেলা উপজেলায় নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

নববর্ষ উদযাপনে মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আনন্দ শোভাযাত্রা

নববর্ষ উদযাপনে মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আনন্দ শোভাযাত্রা

মাজারের বার্ষিক ওরসের মেলায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করল স্বামী

মাজারের বার্ষিক ওরসের মেলায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করল স্বামী

কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে অগ্নিকাণ্ডে পৌনে দুই কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত

কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে অগ্নিকাণ্ডে পৌনে দুই কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত

সরকার নয়, আমরা একটি দেশ হিসেবে কাজ করছি: জ্বালানি উপদেষ্টা

সরকার নয়, আমরা একটি দেশ হিসেবে কাজ করছি: জ্বালানি উপদেষ্টা

মতলবে উপজেলা বিএনপির বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

মতলবে উপজেলা বিএনপির বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

ফিলিস্তিনবাসীদের শান্তি কামনায়   বিশেষ দোয়া মাহফিল

ফিলিস্তিনবাসীদের শান্তি কামনায়  বিশেষ দোয়া মাহফিল

বর্ণাঢ্য ‘ড্রোন শো’ দেখে মুগ্ধ লাখো মানুষ

বর্ণাঢ্য ‘ড্রোন শো’ দেখে মুগ্ধ লাখো মানুষ

নতুন বছরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক  : মঞ্জু

নতুন বছরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক : মঞ্জু

বুধবার ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

বুধবার ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পুরোনো পদে ফিরলেন গাঙ্গুলি

পুরোনো পদে ফিরলেন গাঙ্গুলি

আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমার্জিং নারী ক্রিকেট দল

আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমার্জিং নারী ক্রিকেট দল

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো