আধ্যাত্ম জগতের সূর্যপ্রভা শাহ্সূফি আহসানুল্লাহ রহ.
০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৮ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
একদা হজরতের ঢাকার সাভার বাড়ীর কাছাকাছি কালাতিয়া বাজারের মসজিদ প্রাঙ্গনে মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী কয়েক হাজার লোকের সম্মুখে ইসলামের হুকুম-আহকামের তালীম দিচ্ছিলেন। এ সময় জৈনপুরী হজরত সবার সামনে বলেছিলেন, ‘‘অদূর ভবিষতে আহসানুল্লাহ পূর্ববঙ্গ ও আসামের একজন অতি সুপ্রসিদ্ধ কামেল ও হাদী হিসেবে প্রকাশিত হবে।” উক্ত মজলিসে জৈনপুরী হজরতের স্বরচিত একখানা ‘রাহে নাজাত’ ও ‘মিফতাহুল জান্নাত’ কিতাব তাঁকে উপহার দিয়ে তাঁকে ধন্য করেছিলেন। এরপর থেকেই হজরত কেবলা সক্রিয়ভাবে ভ্রান্ত মতবাদীদের ভ্রান্ত ফতোয়া ও শিরক-বিদয়াতের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে নেমে পড়েন। এরই মধ্যেই হাজী শরীয়তুল্লাহ’র ফরায়েজী আন্দোলনের কুফরী ফতোয়া দুধুমিয়ার নেতৃত্বে বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে। দুধুমিয়ারা এ উপমহাদেশ কে দারুল হারব বলে ঘোষণা র্প্বূক জুমার নামাজ ও দু’ঈদের নামাজ বন্ধ করার অপচেষ্টা চালায়; এ অভিযানে তারা মোটামুটি সফলও হয়েছিল বেশ কিছু জায়গায়। তাদের এ ভ্রান্ত ফতোয়া প্রতিষ্ঠার জন্য বিরুদ্ধাচারীদের উপর নানানভাবে দমন-পীড়ন নীতি বাস্তবায়ন ও গায়েবী মামলা দেওয়ার লক্ষে একটি লাঠিয়াল বাহিনীও গঠন করেছিল। এ সমস্ত ফতোয়ার ফলে ধর্মপ্রাণ মুসলামানদের মাঝে মতানৈক্য ও ধর্মীয় সহিংসতা সৃষ্টি হয়। তাদের এ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা প্রোপাগান্ডাকে শক্তহাতে দমন করতে হজরত ক্বেবলা প্রকাশ্যে; ওয়াজে-বয়ানে ও নসহিতে তাদের এ ঘোষণনাকে কুফরী ফতোয়া আখ্যা হিসেবে আখ্যা দেন। হজরত কেবলা বলেছিলেন, এ উপমহাদেশ দারুল হারব নয় বরং দারুল আমান। একটি দেশ দারুল হারব হওয়ার জন্য যেসমস্ত শর্তাবলীর প্রয়োজন তা এ দেশে অনুপস্থিত। আর এ দেশ দারুল হারব হলে মুসলমানদের এ দেশ ত্যাগ করে দারুল ইসলাম বা দারুল আমান দেশে হিজরত করতে হবে। কিন্তু তারা কুরআন-সুন্নাহ, ইজমা-ক্বিয়াসের দলীলকে উপেক্ষা করে হজরত ক্বেবলার বিরুদ্ধে বিষাদগার ও কুৎসা রটাতে শুরু করে। এ কুচক্রীমহল বহুবার মিথ্যা মামলা সাজিয়ে হজরত কেবলা ও তাঁর অনুসারীদের সম্মানহানি করতে থাকে। এমনকি বেশ কয়েকবার মশুরীখোলা দরবারেও তারা সদলবলে আক্রমণ করে। কয়েকবার হজরত কেবলাকে প্রাণে মেরে ফেলারও চেষ্টা চালায়। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে! আল্লাহ যাঁকে ইজ্জত দেন পৃথিবীর কোন শক্তি তাঁকে বেজ্জুত করতে পারেনা। কারণ আল্লাহ তা’লা মহাপরাক্রমশালী ও সর্বোত্তম হেফাজতকারী। দুধুমিয়াদের কারণে বহু জুমা মসজিদ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কারণ তাদের ঘোষণা বা মতাদর্শ যারা মেনে না নিত তাদের উপর তারা শারীরিক ও মানসিক নিযার্তন চালাত! জুমা মসজিদের মিম্বার ভেঙ্গে ফেলত! ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ঘরবাড়ীও জ¦ালিয়ে দিত! এজন্য তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী ও সমকালীন বাতিলপন্থীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলো। হজরত ক্বেবলার কুরআন-হাদিস ভিত্তিক আলোচনা ও বাহাসের মুগ্ধ হয়ে ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলের লোকেরা পুনরায় জুমার নামাজ আদায় পূর্বক নতুন করে বহু জুমা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এখানে একটি কথা না বললে নয়; সেটি হলো মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী ও তৎকালীন সময়ের সুপ্রসিদ্ধ অনেক আলেমগণ ফরায়েজী আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ; মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী’র সাথে বাহাসে বসার কথা বলে পালায়নও করেছিল একবার।
সূফি আহসান উল্লাহ রহ. ছিলেন মুসলামানদের একজন সংস্কারপন্থী আদর্শিক নেতা। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ কে সঠিক ইসলামী হুকুম আহকামের ভিত্তিতে পরিচালিত করার জন্য আমরণ সংগ্রাম করে গেছেন এ মহান জ্ঞানী। জাহিরি ও বাতিনি ইলমে ভরপুর ছিলো তাঁর সিনা। মিলনধর্মী জ্ঞানের কারণে কোন বাতেল শক্তি তাঁর সামনে অজ্ঞতা পূর্ণ জ্ঞান নিয়ে দাঁড়াতে পারত না। মুহূর্তের মধ্যেই হজরত কেবলার যুক্তিতে ভ্রান্তবাদীরা পরাজিত হত।
হজরত কেবলার স্বভাব চরিত্র ছিলো খুবই উচ্চমার্গীয়। তিনি সবসময় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতেন এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে চলতেন। যার ফলে বহু বিধর্মী তাঁর হাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে সানন্দে। খুবই সিম্পল জীবন-যাপন করতেন। অল্প আহার ও অল্প নিদ্রা করতেন। বিলাসিতা জীবন পরিহার করতেন। রাত জেগে ইবাদাত করতেন। মোরাক্বাবা-মোশাহেদা, তসবিহ-তাহলিল ও দোয়া-দরুদ, তরীক্বত পন্থীদের শিক্ষাদান এবং ইসলামী গবেষণায় নিজকে ব্যস্ত রাখতেন। মুহূর্তের মধ্যেই মানুষের মরা দেল কে জিন্দা করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রেমে নিবেদিত করতেন পারতেন। সবসময় সুন্নতের পাবন্দ ছিলেন। তরীক্বতের নামে ভন্ডামীকে প্রশ্রয় দিতেন না। হালালভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আয়-রোজগার করতেন। পরনির্ভরশীলতা পরিহার করতেন। সবসময় আল্লাহ পাকের ইচ্ছা ও শক্তির উপর ভরসা করে চলতেন। কখনও আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হতেন না। অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। জীবনে কখনও সুন্নতের পরিপন্থী কাজ সমাধা করেননি। আল্লাহ পাকের এ মুহসিন বান্দার কাশফ-কারামত ছিলো অগ্রাহ্যপূর্ণ । তাক্বওয়া ছিলো তাঁর অনুপম চরিত্রের সৌন্দর্যতা। নানা প্রেক্ষাপটের কারণে প্রতিদিন তাঁর থেকে অসংখ্য কারামত প্রকাশিত হত। যা ইন্দ্রিয় লব্ধ নয়। কারামত দ্বারা এ মহান মনীষীর পবিত্র জীবনকে পূর্ণতা দেওয়া যায়না।
সূফি আহসান উল্লাহ ছিলেন একাধারে আত্মিক শুদ্ধ পুরুষ ও প্রতিবাদী রাজনীতিক। সমসাময়িক রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত না থাকলেও পরোক্ষভাবে সম্পৃত্ত ছিলেন; এজন্য তাঁকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকও বলা যায়। বিধর্মীদের সাথে মিলনধর্মী আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিলেন এমনকি গান্ধীর লিডারশীকেও। তৎকালীন সময়ের খিলাফত আন্দোলন ও মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা মাওলানা শওকত আলী (১৮৭৩-১৯৩৯) ও মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর (১৮৭৮-১৯৩১) হজরত কেবলার সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তাঁদের কে উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, বাবা! আপনারা গান্ধীর মিলনধর্মী যুগপৎ আন্দোলন কেন করছেন? এরা পূর্ববর্তী সময়ে মুসলমানদের সাথে ওয়াদা খেলাপ করেছে এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে বিধর্মীর নেতৃত্ব মেনে নেওয়া শরয়ী দৃষ্টিতে অবৈধ। মুসলিম লীগের হাত কে শক্তিশালী করতে সকলকে নির্দেশ দিতেন। কারণ গান্ধীর নেতৃত্ব মেনে নিলে মুসলিম লীগ স্তিমিত হয়ে পড়বে এবং এ পূর্ববঙ্গ পরাধীন থাকবে কখনোও স্বাধীনতার মুখ দেখতে পাবেনা। এজন্য স্বাতন্ত্র্যনীতি এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদী নীতিতে আস্থা রাখতেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম লীগের হাতধরেই এ বাংলা একদিন স্বাধীন হবে। এ দেশকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে প্রায় সময় ফরিয়াদ জানাতেন। তাঁর মৃত্যুর ৪৫ বছর পর আল্লাহ পাক বাংলাদেশ কে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা দান করেছেন। আলহামদুল্লিাহ! হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘‘তোমরা মু’মিনের দূরদৃষ্টি সম্পর্কে সজাগ থাক। কারণ তাঁরা আল্লাহ্ তা’আলার নূরের সাহায্যে দেখে’’। জামে’আত-তিরমিজি- ৩১২৭।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত ‘নাথান কমিশন’র সদস্য শিক্ষাবিদ শামসূল ওলামা আবু নসর মুহাম্মদ ওয়াহিদের হাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে হজরত কেবলা তিন হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। তথ্যসূত্র- বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘জালালাবাদের কথা’ লেখক দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর বইয়ের ৩৯৭ নং পৃষ্ঠায় এ তথ্যটি সংযুক্ত করা হয়েছে। যুগশ্রেষ্ঠ আউলিয়া ও হক্কানী আলেমগণ তাঁকে খুবই সম্মান করতেন। চট্টগ্রামের সুপ্রসিদ্ধ সিলসিলা বারীয়া-হামেদীয়ার পীর-আউলিয়াগণ তাঁদের অনুসারীদের বলতেন, বাবা! আপনারা ঢাকা শহরে আসলে মশুরীখোলা দরবার শরীফের পীর হজরত কেবলার মাজার জিয়ারত করবেন। সময় পেলে জুমার নামাজও আদায় করবেন। (চলবে)
লেখক: সূফিবাদী লেখক ও গবেষক।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

নববর্ষ উদযাপনে মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আনন্দ শোভাযাত্রা

মাজারের বার্ষিক ওরসের মেলায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জবাই করে হত্যা করল স্বামী

কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে অগ্নিকাণ্ডে পৌনে দুই কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত

সরকার নয়, আমরা একটি দেশ হিসেবে কাজ করছি: জ্বালানি উপদেষ্টা

মতলবে উপজেলা বিএনপির বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

ফিলিস্তিনবাসীদের শান্তি কামনায় বিশেষ দোয়া মাহফিল

বর্ণাঢ্য ‘ড্রোন শো’ দেখে মুগ্ধ লাখো মানুষ

নতুন বছরে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হোক : মঞ্জু

বুধবার ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পুরোনো পদে ফিরলেন গাঙ্গুলি

আসছে দক্ষিণ আফ্রিকা ইমার্জিং নারী ক্রিকেট দল

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো

নাসিরনগর প্রশাসনের বর্ষবরণে উপস্থাপক ছাত্রলীগ কর্মী, সাংবাদিককে এসিল্যান্ড বললেন কিছু হবে না!

মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আহমাদ মারা গেছেন

পহেলা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতি, ভালোবাসা আর আনন্দের প্রতীক : সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা

নববর্ষে আইন শৃঙ্খলা সুরক্ষায় প্রশংসনীয় ভূমিকায় র্যাব - ৯