আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব (রহ.)
০১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৯ এএম
বিলাতে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে গৌরবময় ও আলোকিত একটি নাম বিশ্ববিখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব (রহ.)। একজন ওলিয়ে কামেল ও বরেণ্য ইসলামি ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি সকলের কাছে সুপরিচিত ছিলেন। দেখতে দেখতে এই কীর্তিমান আলেমে দ্বীনের ইন্তেকালের ৪টি বছর পূর্ণ হয়ে গেল। ২০২০ সালের ১০ই জুলাই শুক্রবার জুম্মার পূর্বক্ষণে ৯১ বছর বয়সে এই মনীষী লন্ডনে ইন্তেকাল করেন। তিনি আমাদের মাঝে থেকে চিরবিদায় নিয়ে গিয়েছেন; তবে রেখে গিয়েছেন দীর্ঘ জীবনের বহু কীর্তি ও অবদান। এরকম গুণীজনদের জীবন-কর্ম আমাদের আদর্শিক পথ চলায় প্রেরণার সঞ্চার করে।
শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রহ. এর অন্যতম খলিফা, ইউকে ওলামা সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি ও আনজুমানে আল-ইসলাহ ইউকে’র প্রতিষ্ঠাতা, লন্ডন দারুল হাদীস লাতিফিয়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, বৃটেনে বাংলাদেশী শীর্ষ ওলিয়ে কামিল, প্রখ্যাত বুযুর্গ, শায়খুল হাদীস, উস্তাযুল ফুকাহা ওয়াল মুফাসসিরিন, রঈসুল কুররা, মুফতিয়ে আযম, হযরত আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব রহ. ছিলেন সলফে সালেহীনের সুযোগ্য উত্তরসুরী। তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান, একটি উৎকৃষ্টতর চিন্তাচেতনার আলোকবর্তিকা। ইলমে হাদিস, ইলমে তফসীর, ইলমে ফিকহ, ইলমে ক্বিরাত, ইলমে তাসাউফ, দাওয়াত-তাবলিগ, সমাজ সংস্কার, ওয়াজ-নসিহত, শিক্ষকতা, আরবী, উর্দু ও বাংলা ভাষায় বই রচনা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামের খেদমতে ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মিশর, ইয়েমেন, সিরিয়া, কুয়েত, ফিলিস্তিন, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্দান-সহ পৃথিবীর বহু দেশের আকাবির উলামায়ে কেরামের সঙ্গে উঠা বসার সুযোগ হয়েছে তাঁর। সে সব দেশের মশহুর মুহাক্কিক উলামা-মাশায়িখদের সাথে ইলমী আলোচনা করেছেন, হাদীসের সনদ আদান-প্রদান করেছেন। তিনি যেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তিনি এক বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা ও মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি আপন কর্মের দ্বারা তাঁর মুরিদীন-মুহিব্বীন-সহ সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ে বিশাল এক জায়গা দখল করে গেছেন। বিশেষ করে তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসার প্রবীণ আসাতাযায়ে কেরামগণের অন্যতম ছিলেন। তাঁর সময়ে উক্ত মাদরাসা বিশেষ প্রশংসিত হয়। মাদরাসার ইতিহাসে সর্বপ্রথম যে তিনটি প্রথম বিভাগ আসে এর পেছনে তাঁরও অক্লান্ত পরিশ্রম জড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একজন ছিলেন (আমার শ্রদ্ধেয় পিতা) শায়খুল হাদীস মাওলানা মো. আব্দুল মজিদ রহ. এবং বাকি দু’জন হলেন শায়খুল হাদীস মাওলানা মো. রইছ উদ্দিন হামযাপুরী রহ. ও মাওলানা ইমাদ উদ্দিন ওরফে সাজিদুর রহমান রহ.। ফলে সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসার সুনাম ও অগ্রগতির পেছনে আল্লামা দুবাগী ছাহেবের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের প্রবীণ আলিম-ওলামা ও তৎকালীন তরুণগণের কাছে তিনি ‘দুবাগী ছাব’ এবং ‘দুবাগী হুজুর’ নামে খ্যাত ছিলেন।
আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব রহ. সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলাস্থ দক্ষিণ দুবাগ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৯ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম মো. আপ্তাব আলী চৌধুরী। মাতা মরহুমা বিবিজান খাতুন চৌধুরী। পিতা ছিলেন একজন মুত্তাকী-পরহেজগার ব্যক্তিত্ব। মাতা ছিলেন তাপসী, আবেদা-ছালেহা ওলীয়াতুল্লাহ। তিনি বিশেষ দোয়া করলে তা আল্লাহ পাক কবুল করে নিতেন বলে মশহুর ছিল। আল্লামা দুবাগী ছাহেব রহ. প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন পিতামাতার নিকট। তিনি বাল্যকালে মহীয়সী মাতাকে হারান। এর পর তাঁকে ভর্তি করা হয় স্থানীয় মক্তবে। বাড়ি সংলগ্ন জামে মসজিদে ১ বছর জ্ঞানার্জনের পর তাঁকে ভর্তি করা হয় দক্ষিণ দুবাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে ২ বছর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ভর্তি করা হয় মাথিউরা কেন্দ্র পাঠশালায়। উক্ত প্রতিষ্ঠানে ৩ বছর অধ্যয়নের পর তাঁকে ভর্তি করা হয় ইলমে ক্বিরাতের বিশেষজ্ঞ হযরত ক্বারী মাওলানা বশির উদ্দিন ছাহেব রহ. এর কোনাগ্রাম ক্বারীয়ানা মাদরাসায়। উক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্লাসগুলোর কোর্স শেষ করতে যেখানে অনেকের ৬ থেকে ১০ বছর সময় লাগে সেখানে আল্লামা দুবাগী ছাহেব রহ. মাত্র ৩ বছরে কোর্সগুলো বেশ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেন। এর পর তাঁকে ভর্তি করা হয় তদানিন্তন ঐতিহ্যবাহী গাছবাড়ী জামিউল উলূম কামিল মাদরাসায়। উক্ত মাদরাসায় তাঁর প্রখর ধীশক্তির বিকাশ ঘটে। সবার কাছে তাঁর অচিন্তনীয় মেধার পরিচয় ফুটে উঠে। তিনি ছরফ, মীজান, মুনশাইব, পাঞ্জগঞ্জ, নহমীর, হেদায়াতুন্নাহু, মীজান (ফার্সী), মছদর, ছিরাজী, ফরাইজ প্রভৃতি শাস্ত্র ক্লাসগুলোতে কন্ঠস্থ করে কৃতিত্ব দেখান। অতঃপর উক্ত মাদরাসা থেকে ১৯৫৬ সালে দাখিল, ১৯৫৮ সালে আলিম এবং ১৯৬০ সালে ফাজিল জামাত অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও তীক্ষ্ণ জ্ঞানের অধিকারী। আলিম পরীক্ষায় মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্টার মার্কসসহ বৃত্তি পান। অতঃপর সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে ১৯৬২ সালে কামিল কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। কামিল বার্ষিক পরীক্ষায় সিলেট আলিয়া মাদরাসার ক্বাদিরিয়া বৃত্তি লাভ করেন। কামিল ক্লাসে অধ্যয়নকালে সম্মানিত ব্যক্তিগণের অনুরোধে তিনি সিলেট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন।
আল্লামা দুবাগী ছাহেব রহ. ছিলেন একজন বিখ্যাত বাগ্মী ও মুনাযীর। তিনি বাংলা, উর্দু, ফারসী ও আরবিতে অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। ইংরেজি ভাষায় ছিল তাঁর ভালো দখল।
আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব রহ. কর্মজীবনে বাংলাদেশে অবস্থানকালীন বিভিন্ন দ্বীনি দারসগাহে অধ্যাপনা করেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ, শায়খুল হাদীস ও মুফতী হিসাবে ইলমে দ্বীনের খিদমত করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো- সৎপুর দারুল হাদিস কামিল মাদরাসা, শ্রীমঙ্গল আনওয়ারুল উলূম ফাজিল মাদরাসা, মুকিমপুর সিনিয়র মাদরাসা, দাসউরা সিনিয়র আলিম মাদরাসা (বিয়ানীবাজার), তাহিরপুর ইত্তেফাকিয়া আলিম মাদরাসা (নবীগঞ্জ), আটগ্রাম আমজাদিয়া মাদরাসা (জকিগঞ্জ) এবং মেওয়া কুদছিয়া মাদরাসায় (বিয়ানীবাজার) ইলমে দ্বীনের খিদমত করে মাদরাসার ভিত্তিকে মজবুত করতে নিরলস প্রচেষ্টা চালান। এছাড়া অধ্যাপনায় বিশেষ কলাকৌশল ও দক্ষতায় তিনি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বমহলের সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হন।
তিনি কিতাবি ইলমে খুবই পারদর্শী ছিলেন। যখন যে বিষয়ে দারস দিতেন তখন মনে হতো সেই বিষয়েই তিনি বেশী পারদর্শী। সৎপুর মাদ্রাসায় তিনি যাবতীয় কঠিন কিতাবাদি অত্যন্ত সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেন। যতবড় কঠিন কিতাবই দেওয়া হত না কেন, তিনি তা অত্যন্ত সহজ সরল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় পাঠ দান করতেন। কঠিন থেকে কঠিন বিষয়কেও বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে সহজ করে ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। ক্লাসের দুর্বল ছাত্রও তাঁর দরস বুঝতে বেগ পেতে হত না। তিনি অনেক ধৈর্যশীল, সময়ানুবর্তিতা এবং নিয়মানুবর্তিতার পাবন্দী ছিলেন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কঠোর রীতি মেনে চলতেন।
আল্লামা দুবাগী ছাহেব (রহ.) সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসায় নিয়োগ হওয়ার পর মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো দারুল ইফতা বা ফতওয়া বিভাগ কায়েম করেন এবং তিনি প্রধান মুফতির দায়িত্ব পালন করেন। ফতোয়াদানের ক্ষেত্রে তাঁর গভীর দৃষ্টিভঙ্গি ও মৌলিকত্বের কারণে ধীরে ধীরে তাঁর মাধ্যমে ফতওয়া বিভাগের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিজ্ঞ মুফতিয়ানে কেরাম দুবাগী সাহেবের নিকট তাঁদের ফতওয়া সত্যায়নের জন্য প্রেরণ করা আরম্ভ করেন। যুক্তরাজ্যে তিনি ‘মুফতিয়ে আযম বাংলাদেশ’’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। (চলবে)
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, মানিককোনা দারুল কেরাত সুন্নিয়া দাখিল মাদরাসা, ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত
এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে
ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী
আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ
বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত
মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক
ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন
কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু
আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ
ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী
সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু
যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের
পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন
শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি স্থবির খুলনা শহুরে জীবন
টেকসই উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য নীতি করার তাগিদ
লোকসংগীত শিল্পী নিপা আহমেদ সারাহ্ এর একক সঙ্গীত সন্ধ্যা
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি ও হার্ট ফাউন্ডেশনের কর্মশালা
বাফেদার ৩১তম এজিএম অনুষ্ঠিত
পাকিস্তান থেকে যেসব পণ্য নিয়ে এবার এলো জাহাজ