ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেপথ্যকথা
২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০২ এএম

পূর্ব কথা
ফিলিস্তিনের গাজা থেকে দুই মাইল উত্তরে কিবুটস এলাকা। এখানে ১৯৩০›র দশকে পোল্যান্ড থেকে আসা ইহুদীরা কৃষি খামার গড়ে তুলেছিল। ইহুদিদের পাশেই ছিল ফিলিস্তিনী আরবদের বসবাস। সেখানে আরবদের কৃষি খামার ছিল। তারা কয়েক শতাব্দী ধরে সেখানে বসবাস করছিল। সে সময় মুসলমান এবং ইহুদীদের মধ্যে সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ১৯৩০›র দশকে ফিলিস্তিনীরা বুঝতে পারলো যে তারা ধীরে-ধীরে জমি হারাচ্ছে। ইহুদিরা দলে-দলে সেখানে আসে এবং জমি ক্রয় করতে থাকে। এ দিকে উসমানীয় শাসনের শেষ দিকে ফিলিস্তিনের অধিকার নিয়ে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র চলছিল। ঋণচাপে জর্জরিত উসমানীয় সাম্রাজ্যকে আর্থিক সহযোগিতার বিনিময়ে ফিলিস্তিন ভূখ-ের জমি ক্রয় ও ইহুদিদের বসতি গড়ার অনুমোদন নেওয়ার চেষ্টা করেন ইহুদিবাদী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা থিয়োডর হার্জেল। কেননা সে সময় সালতানাতের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্থায়ী বসবাস নিষিদ্ধ ছিল। ১৮৯৬ সালের ১৮ জুন হার্জেলের প্রস্তাবের জবাবে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ বলেছিলেন, ‘আমি দেশের এক কদমও বিক্রি করতে পারব না। কেননা তা আমার নয়; বরং আমার জাতির। আমার জাতি রক্ত দিয়ে এই ভূখ- অর্জন করেছে এবং রক্ত দিয়ে এর সুরক্ষা করবে। লাখ লাখ ইহুদির সুরক্ষার জন্য আমাদের কাছ থেকে তা আত্মসাৎ করার অনুমোদন পাবে না।, কিন্তু হার্জেল বারবার একই প্রস্তাব পাঠালে আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশের এক বিঘা পরিমাণ জমি নিয়েও আপস করব না, বরং এসব অর্জনে আগে আমরা যে পরিমাণ রক্ত ব্যয় করেছি এখন তার চেয়েও বেশি ব্যয় করব। আমি সব নাগরিকের মধ্যে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তবে আমাদের মুসলিম পূর্বপুরুষদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কখনো হ্যাঁ বলতে পারব না। (সুলতান আবদুল হামিদ আল-সানি ওয়া ফিলিস্তিন, রফিক শাকির নাতশা)
বেলফোর ঘোষণার প্রভাব ও তাৎপর্য : ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদি নেতা ব্যারন রথচাইল্ডের কাছে মাত্র ৬৭ শব্দের একটি সংক্ষিপ্ত চিঠি লেখেন। এর ভাষ্য ছিল, ‘মহামান্য (ব্রিটিশ) সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে তার সর্বোত্তম প্রয়াস প্রয়োগ করা হবে এবং এটাও পরিষ্কার যে এখানে এমন কিছু করা হবে না, যা ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার কিংবা অন্য কোনো দেশে ইহুদিদের বিরাজমান অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষুণ্ন করতে পারে।’ আকারে ছোট হলেও তাতে ‘ইহুদি জনগোষ্ঠীর জাতীয় ভূমি প্রতিষ্ঠার’ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে পরিচিত এই চিঠির প্রভাব এতটাই তীব্র ছিল যে ১০০ বছর পরও এর সংকটে ফিলিস্তিনি আরবরা ভুগছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্য পরাজিত হয়। ৪০০ বছরের বেশি সময় উসমানীয়দের শাসনাধীন থাকার পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং এর নাম রাখে ‘ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন’। মূলত ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর ব্রিটিশের অধীনে থাকাকালে ফিলিস্তিনে ইউরোপ থেকে প্রায় চার লাখ ইহুদির আগমন ঘটতে থাকে। পাশাপাশি হাগানাহসহ বিভিন্ন ইহুদি মিলিশিয়া গোষ্ঠীর মাধ্যমে আরব ফিলিস্তিনিদের নিজ বসতি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। বেলফোর ঘোষণার তাৎপর্য বেড়ে যায় এ জন্য যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে উসমানী সালতানাতের কাছ থেকে ফিলিস্তিন ভূখ- ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। ১৯২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশরাজ ম্যানডেটরি প্যালেস্টাইনের শাসনভার গ্রহণ করে, যা চলে ১৯৪৮ সালের মে মাস পর্যন্ত। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনের শাসনভার গ্রহণ করার পর থেকেই সেখানকার ৯০ শতাংশ বা তারও বেশি আরব অধিবাসীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ ও দমননীতি শুরু করে। দীর্ঘ মেয়াদে ইহুদিদের জন্য ঈশ্বর ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ (প্রমিজড ল্যান্ড) তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার কৌশল হিসেবে ইহুদি সেটেলারদের বিভিন্নভাবে অগ্রাধিকার সুবিধা দিতে থাকে। দলে দলে ইহুদিরা ইউরোপ ও অন্য আরব দেশ থেকে ফিলিস্তিনে পাড়ি জমাতে শুরু করে। ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদদেই অভিবাসী ইহুদিদের নিয়ে ১৯২১ সালেই গঠন করা হয় হাগানাহ নামের আধা সামরিক বাহিনী। এরপর আরও দুটি জায়নবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং গড়ে ওঠে।
ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ের মাধ্যমে : ‘ফিলিস্তিনিরা সন্ত্রাসবাদী’ এ কথা বলে ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্ব দশকের পর দশক ধরে প্রচারণা চালিয়ে তাদের ওপর ইসরাইলের সামরিক অভিযান ও হত্যাযজ্ঞকে বৈধতা দিচ্ছে, অথচ ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছে সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ের মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হাগানাহ, ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং একীভূত হয়ে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৩৯-৪৫ কালপর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল আর জার্মানিতে হিটলারের চরম ইহুদিবিদ্বেষ জায়নবাদীদের জন্য বিরাট সুযোগ এনে দেয়। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইউরোপে কমবেশি ৬০ লাখ ইহুদিকে নিধন করা হয়, যা ইতিহাসে হলোকাস্ট হিসেবে স্বীকৃত। যুদ্ধ শেষে এই হলোকাস্টই ফিলিস্তিন ভূখ-ে ইহুদিদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি স্থাপনের সবচেয়ে বড় যৌক্তিকতা হিসেবে তুলে ধরা হয়। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জায়নবাদীরা যে পাপের সূচনা ঘটিয়েছে, তা একাধারে অপরাধ ও দখলদারির মধ্য দিয়ে দশকের পর দশক ধরে বিস্তৃত হয়ে আসছে। এ জন্য ৬৯ বছর ধরে জায়নবাদীরা প্রকৃত ইতিহাসের বিকৃতি শুধু ঘটায়নি, বরং বাছাই করা সত্য ও সযতেœ তৈরি মিথ্যার সুদক্ষ মিশেলে নিজেদের অপকর্মের বৈধতার জন্য বিভ্রান্তিকর ভাষ্য তৈরি করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব বেমালুম এটা ভুলে যায় যে ইহুদি গণহত্যার দায় ইউরোপের, অথচ ক্ষতিপূরণের জন্য মূল্য গুনতে হচ্ছে আরবদের, বিশেষত ফিলিস্তিনিদের। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর সদ্য গঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন ভূখ-কে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে দুই ভাগ করার প্রস্তাব অনুমোদনের মধ্য দিয়ে কফিনের শেষ পেরেকটি পুঁতে দেওয়া হয়। এদিকে জায়নবাদীরা নিজ ভূখ- থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়ার ছক কেটে ফেলে। প্ল্যান দালেত বা প্ল্যান ডি নামে এই পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ান। পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী বেন গুরিয়ান ১৯০৬ সালে অটোমান ফিলিস্তিনে অভিবাসী হয়ে আসেন এবং কট্টর জায়নবাদী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। প্ল্যান ডি ছিল হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি আরবদের নিজ ভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা। ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলে ইসরাইলি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো তা বাস্তবায়নে পুরোদমে নেমে যায়। তখন পর্যন্ত ব্রিটিশদের শাসনাধীনে থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ বাহিনীকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়, যাতে নিরস্ত্র ও অপ্রস্তুত আরবেরা সুরক্ষা না পায়। (চলবে)
লেখক : ইমাম ও খতীব -মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনার পাড়, মোমেনশাহী, সিনিয়র মুহাদ্দিস-জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলূম, তালতলা, মোমেনশাহী
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

'জনতার মেয়রকে পদে বসাতে রাস্তায় নেমেছে জনতা'

বাহরাইনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ

দাউদকান্দিতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে ২২ মামলার আসামি মামুন সম্রাট আটক

আয়নাঘর পরিদর্শনে করেন আরএফকে সেন্টারের প্রধান কেরি কেনেডি

আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের প্রশ্নে যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র

সাম্য দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ছাত্রনেতা: ছাত্রদল সভাপতি

‘সাম্য হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক’

মাদক আস্তানায় পরিণত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান: হাসনাত আবদুল্লাহ

পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনকে পরিবর্তন করছে সরকার

বাংলাদেশের নির্বাচন পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয়: প্রেস সচিব

কাশিয়ানীতে ছিনতাই হওয়া তেলবাহী ট্রাক উদ্ধার

‘মুসলিমদের সঙ্গে শত্রুতা বন্ধ করুন’— ভারতের প্রতি ওমানের গ্র্যান্ড মুফতির আহ্বান

২০২৪ সালে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির রেকর্ড দেখেছে পৃথিবী

ইতালির মাউন্ট এটনায় ফের অগ্ন্যুৎপাত, ছড়াচ্ছে উত্তপ্ত লাভা-ছাই

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সউদী আরবের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঐতিহাসিক চুক্তি

সিরিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেন ট্রাম্প

গাজায় যুদ্ধ থামবে না, হুঁশিয়ারি নেতানিয়াহুর

ইসরায়েলি নৃশংস হামলায় গাজায় নিহত অন্তত ৮১ ফিলিস্তিনি

কালিগঞ্জে প্রশাসনের নাকের ডগায় অবৈধ বালু উত্তোলন, পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ চায় ছাত্রদল