লেখকের দায়বদ্ধতা
২০ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:১৫ পিএম | আপডেট: ০১ মে ২০২৩, ১২:০৭ এএম
গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস আড়াই হাজার বছর আগে এজিয়ান সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে সাগরের তরঙ্গরাশির মধ্যে শুনতে পেয়েছিলেন মানুষের করুণ আর্তনাদ। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ টিনটার্ন এবি’র ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে শুনেছিলেন মানবতার নিরব বিষণœ সঙ্গীত। মসনবি’র জালালউদ্দিন রুমি বাঁশের বাঁশির করুণ সুরের মধ্যে শুনেছিলেন মহান স্রষ্টার মধুর সান্নিধ্য থেকে মানবাত্মার বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনার গান। মধুসূদন মেঘনাদবধ কাব্য কি লিখেছিলেন কেবলি মহাকবির খ্যাতি অর্জনের আশায়? কবি যখন পুত্রশোকে কাতর রাবণের কণ্ঠ দিয়ে এরকম করে বলান-
জন্মভূমি-রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?
যে ডরে, ভীরু সে, মূঢ়, শতধিক তারে
তখন আমরা বুঝতে পারি মেঘনাদবধ কাব্য মূলত স্বাধীনতার গান, পরাধীনতার গ্লানি থেকে বের হয়ে আসার এক বলিষ্ঠ উচ্চারণ, যেখানে ইংরেজ হলো পরদেশআগ্রাসী রাম আর লঙ্কারাজ রাবণ হলো পরাধীন ভারতবাসী। ক্লাসিক সাহিত্য থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের চিরায়ত সব সাহিত্য পর্যালোচনা করলে যে-বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো, মহৎ সব সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে লেখকের এক ধরনের দায়বদ্ধতা থেকে, যেখানে প্রধান হয়ে উঠেছে দেশ, মানুষ, প্রকৃতি ও ধর্ম। ম্যাক্সিম গোর্কির মা কিংবা নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ইস্পাত অমর সাহিত্য হতে পেরেছে তা মানবমুক্তির মুখপত্র হতে পেরেছে বলেই।
টি এস ইলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কোন্ দায়বদ্ধতা থেকে রচিত হয়েছিল, তা বুঝতে পারলেই আধুনিকতার নানা ধুম্রজাল থেকে বের হয়ে আসা আমাদের জন্য সহজতর হয়। ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ একটি প্রতীকী কবিতা; এখানে ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ হলো আত্মাহীন শরীরসর্বস্ব ইউরোপ, যা পড়ে আছে নিস্ফলা জমিনের মতো। কারণ তার কোনো দৃঢ় ধর্মবিশ্বাস নেই। এ-কবিতায় যে যিশুখ্রিস্টের দেখা আমরা পাই, তিনি ক্রুশ বিদ্ধ। ইলিয়ট বলছেন ‘হ্যাঙ্গ্ড ম্যান’। ইলিয়ট বুঝতে পেরেছিলেন ধর্মীয় বিশ্বাসহীন যে-সভ্যতা, তা মানুষের কোনো মুক্তি বয়ে আনবে না। লন্ডন ব্রিজের উপর দিয়ে ছুটে চলা মানুষের মিছিল দেখে কবির মনে হয়েছিল, এরা সব যেন নরকপুরীর প্রেতাত্মা। কবি মানুষের আত্মিক মুক্তির জন্য হাহাকার করে উঠেছেন সমস্ত কবিতায় সাধু-সন্তুর মতো।
রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন মুখর হয়েছেন তাঁর স্বপ্নের উপনিষদীয় জগতের জয়গানে, তেমনি অন্যদিকে পরম মমতায় নিপুণ হস্তে এঁকে গিয়েছেন শাশ্বত বাংলার ছবি। বাংলার প্রকৃতিকে, রবীন্দ্রনাথের অধিক, এত বেশি অংকন করেছেন কে আর বাংলা কবিতায়? তাঁর ছোটগল্প, নাটক ও উপন্যাস ধারণ করে আছে বাংলার মাটি ও মানুষ। নজরুল নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার ঘোষক হয়ে হতে পেরেছেন বিশ্বের কবি। স্বাধীনতা, সাম্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার এমন বিপ্লবী কবি আর একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না বাংলায় কিংবা বিশ্বে। জসীম উদদীন ধারণ করে আছেন সবুজ সুফলা সুবর্ণ বাংলাদেশ। এভাবে জীবনানন্দ দাশ-ফররুখ আহমদ থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ পর্যন্ত যদি আসি, আমরা দেখতে পাবো, বাংলা ভাষার কোনো মৌলিক কবি-সাহিত্যিক কখনোই বিচ্যুত হননি তাঁদের মূল ও শিকড় থেকে। স্বদেশ, স্বজাতি, স্বধর্ম, স্বসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেই কেবল রচিত হতে পারে কোনো ভাষার মহৎ সাহিত্য। শেক্সপিয়ার বলি, ভিক্টর হুগো বলি, ইকবাল কিংবা টলস্টয়, কেউই এ দায়বদ্ধতার বাইরে নন। হাল-আমলের লুইস গ্লুক সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে, হৃদয়ের রঙ ঢেলে তাঁর কবিতার পরতে পরতে এঁকে গিয়েছেন তাঁর জন্মভূমি আমেরিকার ছবি। স্বদেশের কবিতা লিখেই তিনি বিশ্বের কবি, গর্বিত নোবেল-লরিয়েট। একজন লেখককে একথা ভুলে গেলে চলে না যে, সাহিত্য স্বগৃহ থেকেই শুরু; আগে চাই নিজের মাটি ও মানুষ, তারপর গোটা পৃথিবীকে।
একজন লেখকের প্রথম দায়বদ্ধতা তাঁর বিশ্বাসের সাথে। যা সে বিশ্বাস করে না, তা নিয়ে জবরদস্তি হয়, সাহিত্য হয় না। নাজিম হিকমত, সুকান্ত ভট্টাচার্য কিংবা সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের বিশ্বাসের জায়গা থেকেই সাহিত্যচর্চা করে গেছেন এবং হৃদয় থেকে উৎসারিত বলেই তা ছুঁতে পেরেছে পাঠকের হৃদয়। তদ্রƒপ, ফররুখ আহমদ, ইকবাল কিংবা লিউ টলস্টয়, তাঁরাও তাঁদের বিশ্বাসের জায়গা থেকে সরে যাননি একচুলও; তাঁরাও অমর তাঁদের বিশ্বাসজাত সাহিত্যফসলের জন্যে। ফররুখের ‘সাত সাগরের মাঝি’, ইকবালের ‘শিকওয়া’ কিংবা টলস্টয়ের ‘একজন মানুষের কতটুকু জায়গা প্রয়োজন’ কাকে না আপ্লুত করে আজও?
ছোট ও দুর্বল লেখক যারা, তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই; তারা কেবল বিতর্ক ও হৈ চৈ করেই ঢেকে ফেলতে চায় তাদের দুর্বলতা; তারা এমন সব হুতোমপেঁচা, যাদের কণ্ঠ কর্কশ, তাদের না আছে কোনো দেশ, না অরণ্য, না মৃত্তিকা; তাঁরা যতদিন বেঁচে আছে, ততদিনই তাদের সাহিত্যের আয়ু; তারা মরে যাওয়ার সাথে সাথেই মুখ থুবড়ে পড়ে তাদের আরোপিত মতবাদ ও একচক্ষু রাজনীতি।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বেশি টাকা গুণলেই গোপনে মিলছে সার
ঘোড়াঘাটে পাওয়ার টিলার ট্রলি চালাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
সিন্ডিকেটের প্রভাবে পেঁয়াজ চাষীদের মাথায় হাত
গাড়ি নিয়ে খালেদের বাহাস, স্পষ্ট করে যা বললেন হাসনাত
চন্দ্রঘোনায় প্রতিষ্ঠান ওমরা হজ্জ্ব ঘোষণা
অপহরণের ১২ ঘণ্টা পরেও উদ্ধার হয়নি মার্চেন্ট ব্যবসায়ী
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রতিটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে: প্রকৌশলী জাকির সরকার
কাতারের কাটারা কালচার ভিলেজে বাংলাদেশি চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন
সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আরব সফরে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে বিনিয়োগের আহ্বান জানাবেন
ভারতে আটক জেলেরা দেশে ফেরত আসতে পারেন সোমবার
কুষ্টিয়ায় বিএনপি নেতার বাড়ি থেকে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার
পিকআপ ভ্যান ও মোটরসাইকেলের সংঘষে যুবক নিহত
ছাত্রদের মনে রাখতে হবে শুধু স্লোগান দিয়ে দেশ শাসন করা যায় না- ডঃ আব্দুল মঈন খান
শেরপুরে আ.লীগ নেতা ইউপি চেয়ারম্যান বিল্লাল চৌধুরীসহ গ্রেফতার-২
ইসরায়েলি বাহিনী গাজার দুটি হাসপাতাল খালি করার নির্দেশ,বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্বেগ
নোয়াখালীতে মাটির ট্রাক চাপায় প্রাণ গেল কিশোর চালকের
আমরা চাঁদাবাজ-দখলদারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই : ডা.শফিকুর রহমান
কলাপাড়ায় মাছ বোঝাই পিকআপের চাঁপায় শ্রমিকের মৃত্যু, চালক আটক
উত্তরখানে পুলিশ ছাত্র-জনতা ও নাগরিক সমাজের সমন্বয় সভা
তারেক রহমানের চার মামলা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল