মাদরাসা শিক্ষায় মাওলানা এম এ মান্নানের অতুলনীয় অবদান
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৭ এএম
মাওলানা আবদুল মান্নানের জীবনের সর্বপ্রধান পেশা ও নেশা ছিল আলিয়া নিসাবের মাদরাসার সর্বাঙ্গীন উন্নয়ন। মাওলানা আবদুল মান্নানের মতো নিবেদিতপ্রাণ সেবকের আবির্ভাব না হলে বিংশ শতাব্দিতে বাংলাদেশের আলিয়া মাদরাসাসমূহের যে স্তরে পৌঁছেছে সে উন্নীত স্তরে হয়তো থাকতো না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সর্বশক্তিমান। তিনি আলিয়া মাদরাসার বহুমুখী উন্নয়নে মাওলানা আবদুল মান্নানের মেধা, শ্রম ও অবদান কবুল করে নিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক মাদরাসা শিক্ষকের জন্য সরকারি অনুদান বা ভাতা ছিল মাথাপিছু মাসিক তিন টাকা। আলিম ও কওমী লাইনের পঞ্চম ক্লাস স্তরের শিক্ষকগণ এ ভাতা পেতেন। বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকগণও ভাতা পেতেন মাসিক তিন টাকা। সরকারি অনুদান হিসেবে প্রতি কলেজ শিক্ষক পেতেন মাথাপিছু ভাতা মাসিক পাঁচ টাকা।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মাদরাসা শিক্ষকের ভাতা ছিল মাথাপিছু মাসিক পাঁচ টাকা। যারা শিক্ষক নন ঐ সময়ে তাদের মাসিক ভাতা ছিল মাথাপিছু মাসিক তিন টাকা। ১৯৫৭ সালে মাওলানা এম এ মান্নান এবং অন্যান্যদের প্রচেষ্টায় বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসা শিক্ষকের ভাতা বা অনুদান করা হয় মাসিক দশ টাকা। শিক্ষক নন এরূপ কর্মকর্তাদের জন্য অনুদান তিন টাকা থেকে পাঁচ টাকায় বৃদ্ধি করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ।
১৯৬২ সালে হযরত মাওলানা এম এ মান্নান ইস্ট পাকিস্তান আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি খুব সম্ভব ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আইন সভার সদস্য ছিলেন। জুলাই ১৯৬২ থেকে মার্চ ১৯৬৫ পর্যন্ত মাওলানা এম এ মান্নান ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসেম্বলির পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন।
মাওলানা আবদুল মান্নান শুধুমাত্র মাদরাসা শিক্ষকদেরই প্রতিনিধিত্ব করতেন, তা নয়। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের স্বার্থের প্রতিও তিনি উদাসীন ছিলেন না। সর্বস্তরে তিনি তাদেরও প্রতিনিধিত্ব করতেন। ঐ সময় বেসরকারি স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বকারী মাওলানা আবদুল মান্নানের মতো প্রতিভাধর প্রতিনিধিত্বকারী কাউকে দেখা যায়নি। তাই স্কুল-কলেজ শিক্ষকগণও মাওলানা আবদুল মান্নানের পেছনে কাতরবন্দি হন। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইন সভায় মাওলানা আবদুল মান্নান বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য সরকারি অনুদান বৃদ্ধির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। তার এ ভাষণ এবং আন্দোলনের ফলে স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য মাসিক অনুদান দশ টাকা থেকে বিশ টাকায় উন্নীত হয়।
বেসরকারি স্কুল শিক্ষকদের পদবী ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার বা সহকারী শিক্ষক। শুধু ক্ষুদ্র কলেজের শিক্ষক নন, জগন্নাথ কলেজের ন্যায় বৃহৎ কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকের মাসিক সরকারি অনুদান হয়েছিল বিশ টাকা। শিক্ষক নয় এমন কর্মচারীদের জন্য সরকারি অনুদান ছিল সে সময় মাথাপিছু দশ টাকা। তখন মাওলানা এম এ মান্নান ছিলেন বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসা শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের কনভেনর।
১৯৭০ সালে রিয়াল অ্যাডমিরাল এস এম আহসান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। তিনি ইতিপূর্বে ছিলেন ইপিআইডব্লিওটিএ-এর চেয়ারম্যান। তখন থেকেই মাওলানা এম এ মান্নানের সাথে এস এম আহসানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তারই সময় এবং মাওলানা মান্নানের প্রচেষ্টায় শিক্ষকদের জন্য সরকারি অনুদানের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়।
শিক্ষকদের জন্য সর্বনিম্ন অনুদান মাসিক বিশ টাকা থেকে পঁয়ত্রিশ টাকাতে বৃদ্ধি করা হয়। কামিল এবং এমএ পাস শিক্ষকদের মাসিক ভাতা করা হয় ৬৫ টাকা। ৩৫ টাকা এবং ৬৫ টাকার অন্তর্বর্তী শিক্ষকদের আরো দু’টি গ্রেড ছিল মাসিক ৪৫ এবং ৫৫ টাকা।
১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে সকল শিক্ষকদের জন্য সরকারি অনুদান ১০০ টাকা করা হয়।
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান ছিলেন বাংলাদেশ ‘ফেডারেশন অব টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব নন গভর্নমেন্ট স্কুল, কলেজ অ্যান্ড মাদরাসা’-এর আহ্বায়ক (১৯৭৮)।
১৯৭৮ সালে সকল বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য সরকারি অনুদান করা হয় ২০০ টাকা।
১৯৭৯ সালে অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ফেডারেশন অব টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে বাংলাদেশ ফেডারেশন অব টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে স্বাক্ষর করেন মাওলানা আবদুল মান্নান।
এ চুক্তি অনুসারে শিক্ষকদের সমস্যা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যে কমিটি গঠিত হয়, এর সভাপতি ছিলেন কাজী আনোয়ারুল হক এবং সচিব ছিলেন শিক্ষা সচিব মুজিবুল হক সিএসসি। পরবর্তীতে কাজী ফজলুর রহমান সিএসপি।
কাজী আনোয়ারুল হকের পর এ কমিটির সভাপতি হন শিক্ষামন্ত্রী কুষ্টিয়ার শাহ আজিজুর রহমান। শিক্ষ প্রতিমন্ত্রী আব্দুল বাতেন এ কমিটির সদস্য ছিলেন। এ কমিটির সুপারিশক্রমে কলেজ শিক্ষকদের চারটি স্তরে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। যেমন- ১. প্রভাষক, ২. সহকারী অধ্যাপক, ৩. সহযোগী অধ্যাপক এবং ৪. অধ্যাপক। এরূপ চারটি পদবিন্যাস পূর্বে ছিল না এবং যা এখনো চালু আছে।
এ কমিটির সুপারিশক্রমে শিক্ষকদের চাকরিবিধি প্রণীত হয়। চাকরিবিধির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল দোষী শিক্ষকদের বরখাস্তকরণের এবং শাস্তির বিধিমালা প্রণয়ন।
প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান শিক্ষকদের জন্য চাকরিবিধি প্রণয়ন এবং তাদের প্রাপ্য সম্পর্কে খুবই সহানুভূতিশীল ছিলেন। জিয়াউর রহমানের ওয়াদার ভিত্তিতে ১৯৮১ সালের জুন মাসে তার মৃত্যুর পর শিক্ষকগণ এক সঙ্গে সতের মাসের শিক্ষক অনুদান পান। এ জন্য সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হয় ৫৯ কোটি টাকা।
শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন এ সময় শিক্ষামন্ত্রী। এ দাবি পূরণে মাওলানা এম এ মান্নানের অবদান ছিল অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শিক্ষকগণ জাতীয় সমস্যাসমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮২ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশ ফেডারেশন অব টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মাওলানা এম এ আবদুল মান্নান নির্বাচিত হন সেক্রেটারি জেনারেল। এ সময় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসার শিক্ষকগণ সরকারি স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসার শিক্ষকদের মূল বেতনের ৫০ শতাংশ অনুদান হিসেবে পাবেন। যদিও এ সিদ্ধান্তু গৃহীত হয় ১৯৮২ সালে, কিন্তু তা বাস্তাবায়িত হয় ১৯৭৯ সাল থেকে। এ সময় শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পদবী ইত্যাদি সরকারিভাবে নিরীক্ষা করা হয়নি।
১৯৮৩ সালে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য অনুদান সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মূল বেতনের ৬০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য বাড়ি ভাড়া নির্ধারিত হয় মাসিক ২০০ টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা নির্ধারিত হয় ২০০ টাকা মাসিক। এ অনুদান শিক্ষক ছাড়া অন্যান্য কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়।
মাওলানা এম এ মান্নানের প্রচেষ্টার ফলে ১৯৮৬ সালে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য অনুদান সরকারি শিক্ষকদের মূল বেতনের ৭০ শতাংশে উন্নীত করা হয়। ১৯৮৬ সালের জুন মাস থেকে ১৯৮৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত মাওলানা এম এ মান্নান বাংলাদেশ সরকারের ধর্মমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮৭ সালের মহাবন্যার সময় তাকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়।
মাদরাসা শিক্ষা উন্নয়ন ও শিক্ষকদের কল্যাণে মাওলানা আবদুল মান্নানের অবদান উপমহাদেশে অতুলনীয়। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ব্রিটিশদের উপমহাদেশ ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ বিলীন না হলেও আধমরা হয়ে ছিল। নিজস্ব পরিমণ্ডলে মাওলানা আমিনুল ইসলাম, মাসিক মদিনার সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দীন খান প্রমুখ খ্যাতনামা মহান ব্যক্তিবর্গ অতুলনীয় অবদান রেখেছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আলিয়া মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে মাওলানা আবদুল মান্নানের অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক: সাবেক সচিব, গবেষক, গ্রন্থকার
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শেরপুরে ডিসি লেকে ফের চালু হলো প্যাডেল বোট
জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে সাংবাদিক ডালিমের লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করলেন প্রধান বিচারপতি
জুলাই অভ্যুত্থানে আহত বিএসএমএমইউতে চিকিৎসাধীনদের আন্দোলন : সারজিসের আশ্বাসে অবরোধ প্রত্যাহার
৪৬ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে দনিয়া কলেজ ছাত্রদলের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত
খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন সেনাপ্রধান
কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে প্রতিশ্রুত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করতে চাই: সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা
তারকাখচিত বরিশালকে উড়িয়ে রংপুরের তিনে তিন
নতুন ছয় লাখ টিসিবি কার্ড বিতরণ করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা
সিংগাইরে শীতার্তদের মাঝে ইউএনও’র কম্বল বিতরণ
বিস্ফোরক মামলায় নিক্সন চৌধুরীর অন্যতম সহযোগী জব্বার মাস্টার গ্রেপ্তার
২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেল রিজার্ভ
সাবেক এমপি কবির উদ্দিন আহমেদ আর নেই
রেকর্ড ৫,৬৩৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা সোনালী ব্যাংকের
১৪৮ চিকিৎসককে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বদলি
৭ উইকেট ছেলেকে দিলেন তাসকিন
প্রধান উপদেষ্টার রাজবাড়ী সফর স্থগিত
ভিসা সত্যায়নের বেড়াজালে বিপুল সংখ্যক সউদীগামী কর্মী বায়রা নেতৃবৃন্দের সাথে বিএমইটির ডিজি
মোবাইলের ব্যাককভারে প্রিন্ট করা ছবি লাগানো প্রসঙ্গে
প্রেমিকাকে বিয়ে করলেন জনপ্রিয় গায়ক আরমান মালিক
সরকারি দপ্তরে তদবির বন্ধে সচিবদের উদ্দেশে পত্র দিয়ে তথ্য উপদেষ্টার অনন্য দৃষ্টান্ত