সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার কতটুকু এগিয়েছে?
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:১৪ পিএম
মহান একুশে আমাদের জাতীয় অহংকার, যা জাতি, দেশ কিংবা সমাজকে যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা জোগায়, শক্তি জোগায়, সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। বাঙ্গালির আত্মোপলদ্ধি, জাতীয় অস্থিত্ব এবং সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত মান-মর্যাদার প্রশ্নটিই মহান মাতৃভাষার লড়াইয়ে রূপান্তরিত হয়ে এক জাতিগত গর্ব ও গৌরবের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। মা ও মাটির সাথে যেমন নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, মাতৃভাষার সাথেও থাকে তেমন সম্পর্ক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে বাঙ্গালি বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে এভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়নি। সালাম, জব্বার ও রফিকের মত অনেক বীর ভাষা সৈনিক বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেন। বাঙ্গালি জাতির গৌরব ও রক্তে রঞ্জিত বেদনার ইতিহাস ও শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) সাধারন পরিষদে এ দিবসটিকে ‘আন্তজাতিক জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে উদযাপনের একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয় ‘১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে মাতৃভাষার জন্য অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ এবং সেদিন যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে দিনটিকে ‘আন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার প্রস্তাব করা হচ্ছে।’ মাতৃভাষার গৌরব ও মহিমা প্রতিষ্ঠার দীপ্ত প্রত্যয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে যে মহান আত্মত্যাগের নজির সৃষ্টি করেছিল প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে তাদের সেই মহান ত্যাগের মহিমা আন্তজাতিক স্বীকৃত পেল।
আমাদের দেশে ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এ বিধান কার্যকর করতে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়, এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সবক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। সংবিধানের ১৫৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাটা প্রাধান্য পাবে। অর্থাৎ বাংলাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। আইন করার পরে যে সর্বস্তরে পুরোপুরি বাংলার প্রচলন হয়েছে, সেটা বলতে পারিনা। উচ্চ আদালতে এবং ব্যাংকে পুরোপুুরি চালু হয়নি।
আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রেও, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জটিলতা থেকে গেছে। আবার আমাদের বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যপুস্তক খুললে ভুল বানান আর ভুল বাক্য দেখা যায়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অধিকাংশ শিক্ষকেরই নেই প্রমিত বাংলা উচ্চারণ দক্ষতা। শিক্ষকরা যখন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন তারাও তখন প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেন না। কথা হচ্ছে যে, ভাষার আঞ্চলিক রূপ আছে, প্রমিত রূপও আছে। আবার ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বাংলার চেয়ে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার হয় বেশি। ব্যাংকে হিসাব খোলার ফরম, বিদ্যুৎ বিল, ওয়াসার পানির বিল ইত্যাদি বিভিন্ন বিল ইংরেজিতে তৈরি হয়। এখন আমাদের করণীয় হল, জ্ঞানের সর্ব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে প্রয়াস চালনো। মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে তেমনি ভাবে নিজেদের প্রস্তুত করা। বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালত থেকে ২০১৪ সালে নির্দেশনা পাওয়া গিয়েছিল। ইংরেজিতে থাকা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন, গাড়ির নামফলক, সব ধরনের সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলা লিখার ব্যাপারে বলা হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়; বাংলাকে সরিয়ে ইংরেজিতে লেখা হয় সাইনবোর্ড, বিশেষ করে শহরের অভিজাত অঞ্চলগুলোতে। আর বাংলায় লিখলেও অনেক গুলোতে দেখা যায় ভুলের ছড়াছড়ি।
জ্ঞানার্জন করতে হলে মানুষের অবশ্যই প্রয়োজনীয় ভাষা জ্ঞান থাকতে হবে। পড়াশুনার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের সঙ্গে, ভাষার চর্চাও যথেষ্ট পরিমান বৃদ্ধি পায়। প্রত্যেক মানুষের কাছে মাতৃভাষা সর্বাধিক প্রিয়। মায়ের প্রতি যেমন আন্তরিক শ্রদ্ধা, মাতৃভাষার প্রতিও গভীর অনুরাগ-শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালবাসা থাকে। মায়ের কাছ থেকে প্রথম এ ভাষা শেখা শুরু। তাই জগতে পদার্পন করার পর থেকে মাতৃভাষার সঙ্গে আমাদের আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। মায়ের বুলি দ্বারাই আমরা আমাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, মায়া-মমতা ইত্যাদি মনের ভাব প্রকাশ করি। প্রকৃতপক্ষে ভাষা আল্লাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি। প্রখ্যাত ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষের স্বভাবের মধ্যে যদি ভাষার বীজ না থাকত, তাহলে ভাষার অস্তিত্ব সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যেত না। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির সঙ্গে তার মধ্যে ভাষার বীজ রেখে দিয়েছেন। এদিক থেকে ভাষাকে মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব দান বলা যেতে পারে।’ মাতৃভাষার সঙ্গে শিশুমনের একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে; সেই সম্পর্ক পারিবারি ও সামাজিক পরিবেশে লালিত হবার সুযোগ পায়। তাই মাতৃভাষার সাহায্যে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফুর্তভাবে যে ভাবের আদান-প্রদান ঘটে, তা হয়ে ওঠে সহজ ও অন্তরঙ্গ। যথার্থ দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যাবে, বাল্যশিক্ষার সঙ্গে মাতৃভাষার এতখানি নিবিড় যোগ থাকার ফলে শিক্ষার আলোক মনের দৃষ্টি উন্মুক্ত করে দেয়।
জীবনকে ব্যবহারিক জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য লাভ করতে সহায়তা করে। মাতৃভাষার মাধ্যমে যাবতীয় বিষয়ের শিক্ষাদান আমাদের অতি প্রয়োজনীয় কর্তব্য। এ কর্তব্য কেবল শিক্ষার সম্পূর্ণতার জন্য, শিক্ষার সার্বজনীনতার জন্য নয়, মাতৃভূমির ও মাতৃভাষার মর্যাদা ও গৌরব প্রতিষ্ঠার জন্যও। এ বিষয়ে এখনো যতটুকু অসম্পূর্ণতা আছে, তা বিদূরিত করতে হবে। বিশে^র বিভিন্ন দেশ যেমন ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডের উচ্চ আদালতে বিচার কাজ চলে তাদের নিজ মাতৃভাষায়। সম্পূর্ণ বিচার কার্যাক্রম ও রায় মাতৃভাষায় প্রদান করলে উভয় পক্ষের বিচার প্রার্থীদের বক্তব্য প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরা সহজ হয়। আমাদের দেশে উচ্চ আদালতে রায় লেখায় বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ছে। আবেদনও বাংলা ভাষায় করা যায়। অপরদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন কাগজপত্রে ইংরেজি ভাষার প্রচলন থাকায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ এর লক্ষ্য বাস্তবায়ন ও গ্রাহকদের সুবিধার্থে ঋণ অনুমোদনের চিঠিতে বাংলা ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়।
বিশে^র বিভিন্ন দেশ মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করে নিদেজেদের অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। চীন শুধু চীনা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করার ফলে চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বেশি। চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি এই দেশগুলো তাদের নিজস্ব ভাষায় বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল প্রকাশ করে। রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব করেছে মাতৃভাষায় প্রযুক্তি চর্চার মাধ্যমে। পরিশেষে বলব, আমরা আমাদের মাতৃভাষার পাশাপাশি বিশ্বের অন্য ভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাব। অন্য ভাষা শিখতে হবে কিন্তু সেটা আমাদের বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে নয়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় সমস্যা আছে তা বের করে পরিকল্পনা অনুসারে সমাধান করতে হবে। রাষ্ট্রের একটা ভাষানীতি ও ভাষা পরিকল্পনা থাকা দরকার। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাংলা শিক্ষক পদায়ন করা দরকার। এক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা, শিশু শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা শব্দের উচ্চারণ ও বানান শেখে। অফিস-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থায় বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় যথাযথভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে। তবেই বাংলা ভাষা ও ভাষা দিবসের যথাযথ মূল্যায়ন হবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আওয়ামী স্বৈরাচারের দোসর ব্যারিস্টার সুমন দুই দিনের রিমান্ডে
মহাখালীতে এটিএম বুথ ভাঙচুর চালান ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা
শুধু আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী নয়, সন্ত্রাস লালনকারী দলটিরও বিচার হতে হবে - খেলাফত মজলিস
চাপ মেনে নিয়েই হুঙ্কার ছাড়লেন কামিন্স
৬ ঘণ্টা পর মহাখালীতে যান চলাচল শুরু, কমেনি যানজট
খাগড়াছড়িতে দুর্গম লম্বাছড়া গ্রামে স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মিত
ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করল রাশিয়া
সখিপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর হামলার মামলায় গ্রেফতার ২
সাফজয়ী ঠাকুরগাঁওয়ের তিন নারী ফুটবলারকে জেলা প্রশাসনের সংবর্ধনা
শিক্ষার্থীদের ওপর অটোরিকশা চালকদের হামলা
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ এ পদার্পণ, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
বিশ্ব ওয়ান হেলথ দিবসের প্রতিযোগিতায় সিভাসু’র শিক্ষার্থীদের সাফল্য
নতুন লুকে দর্শকদের নজর কেড়েছেন পাকিস্তানি অভিনেত্রী
পদ্মা ব্যাংকের ঋণ খেলাপি শেরপুর চেম্বার অবকমার্সের সাবেক সভাপতি সেলিম গ্রেপ্তার
সাতক্ষীরা খেলোয়াড় তৈরির উর্বর ভূমি: অধিনায়ক সাবিনা খাতুন
বাংলাদেশকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন সার দিচ্ছে রাশিয়া
যৌক্তিক সমালোচনা মানতে সমস্যা নেই পাকিস্তানের নতুন কোচের
সেনাকুঞ্জে পৌঁছেছেন খালেদা জিয়া
ধামরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় পোশাক শ্রমিক নিহত, মহাসড়ক অবরোধ
সেনাবাহিনী যেতেই রাস্তা ছেড়ে পালালেন রিকশাচালকরা!