সাইবার গ্যাঙের তথ্যফাঁস ও অনলাইন জুয়া বন্ধ করতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

১১ মে ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১১ মে ২০২৪, ১২:০৬ এএম

সারাবিশ্ব ডিজিটালাইজ হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ মাধ্যম, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন থেকে শুরু করে সব ধরনের কর্মকা- সহজ হয়ে গেছে। মুহূর্তে সব কাজ সম্পন্ন করতে পারছে। তবে ডিজিটালাইজেশন যেমন মানুষের অফুরন্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছে, তেমনি ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ মাধ্যমে ‘সাইবার গ্যাঙ’ গড়ে উঠেছে, যারা মানুষের ব্যক্তিগত ও গোপন তথ্য, ব্যাংকিং লেনদেন প্রকাশ এবং আদান-প্রদান করে অপূরণীয় ক্ষতি করছে। অথচ ডিজাটালাইজেশনের সাথে সাথে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হয়, যাতে কারও কোনো তথ্য অন্যের হাতে চলে না যায়। ডিজিটালাইজেশনের বাইরে বাংলাদেশও নয়। তবে দেশ ডিজিটালাইজেশন হলেও এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুরক্ষিত নয়। তথ্য সংরক্ষণ ও তার নিরাপত্তা ব্যবস্থার সাথে যারা জিড়িত তাদের একটি শ্রেণী মানুষের ব্যক্তিগত গোপন তথ্য প্রকাশ করে দিচ্ছে। সাইবার গ্যাঙ-এর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে কিংবা নিজেরা জড়িত হয়ে অর্থের বিনিময়ে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি করে দিচ্ছে। গতকাল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইবার গ্যাঙ আসল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিক্রি করছে। নির্বাচন কমিশনে কর্মরত দুর্নীতিবাজ কর্মচারি এ গ্যাঙের সাথে জড়িয়ে অর্থের বিনিময়ে এনআইডি কার্ড বিক্রি করছে। শুধু তাই নয়, এনআইডি’র তথ্যের পরিবর্তন করে সরবরাহ করছে। তারা ওয়েবসাইট, টেলিগ্রাম চ্যানেল, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফেসবুকে গ্রুপ খুলে ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে এ কাজ করছে। শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, অন্যান্য সরকারি দফতর থেকেও মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সিটিটিসি ইউনিট এ অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে কুড়িগ্রামে নির্বাচন অফিসে কর্মরত এক ডাটাএন্ট্রি অপারেটরকে গ্রেফতার করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি এক ভয়ংকর বিষয়। দেশের বিভিন্ন নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে শুরু করে সরকারি অফিসে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার বিষয়টি যে কতটা নাজুক হয়ে পড়েছে, তা এ ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না।

নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি অফিস থেকে ব্যক্তিগত গোপন তথ্য ফাঁস হওয়া নিয়ে অনেক আগেই বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে সতর্ক করেছিলেন। দেখা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে শৈথিল্য প্রদর্শন করছে। এনআইডি, পাসপোর্ট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ভূমি অফিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মোবাইল ফোন কোম্পানি থেকে শুরু করে সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য থাকে। এ তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকাশ না করলে অন্য কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এ তথ্য জানতে পারে। এর বাইরে অন্য কারো জানার সুযোগ নেই। দেখা যাচ্ছে, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব যাদের উপর ন্যাস্ত, তাদেরই একটি শ্রেণী অর্থের বিনিময়ে অন্যের কাছে তা বিক্রি করে দিচ্ছে। তথ্য নিয়ে ব্যবসা করছে। এতে ব্যক্তির অর্থসম্পদ এমনকি জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়া অসম্ভব নয়। এখন সব কাজে এনআইডি অত্যাবশ্যক। একটি মোবাইল সিম নিতেও এনআইডি’র প্রয়োজন। মোবাইল নম্বর বা ই-মেইলের মাধ্যমে ফেসবুক থেকে শুরু করে অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত হতে হয়। অর্থাৎ ব্যক্তিগত তথ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ ছাড়া অন্য কারো জানার সুযোগ নেই, যদি না ঐ কর্তৃপক্ষ নিজ থেকে প্রকাশ করে। অনেক সময় কারো এনআইডি’র তথ্য পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। এজন্য যথাযথ নিয়মে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে তা পরিবর্তন করতে হয় এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতিবাজ চক্র অর্থের বিনিময়ে এনআইডি’র তথ্য পরিবর্তনের কাজ সহজে করে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে কোনো অসাধু ব্যক্তি বা ভয়ংকর অপরাধী তার নামসহ অন্যান্য তথ্য পরিবর্তন করে পার পেয়ে যেতে পারে। নাম ও তথ্য পরিবর্তনের কারণে অন্যের জমি কিংবা সহায়সম্পত্তির মালিকও হয়ে যেতে পারে। এতে যে কেউ প্রতারণার শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে। ডিজিটালাইজেশনের কারণে সাইবার গ্যাঙ কর্তৃক একদিকে যেমন ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের শঙ্কা থাকে, তেমনি বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকা- ও অর্থপাচারের সুযোগ থাকে। বিগত বছরগুলোতে অনলাইনে জুয়া খেলে অনেকে নিঃস্ব হয়েছে, অনেকে এর মাধ্যমে দেশের অর্থ পাচার করে দিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ চৌধুরী স্বয়ং জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন, অনলাইন জুয়া, হুন্ডিসহ অপরাধমূলক বিভিন্ন কারণে দেশ থেকে অর্থপাচার হয়ে যাচ্ছে। কিছু অসাধু চক্র অনলাইন জুয়া-বেটিং, গেমিং, ফরেক্স/ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং হুন্ডি ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে অনলাইন জুয়ায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৪৮ হাজার ৫৮৬ মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস অ্যাক্যাউন্ট বাতিল করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, অনলাইনে কী ভয়াবহ অপকর্ম চলছে। অনলাইন জুয়ার বিস্তার নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, তরুণ সমাজকে এ থেকে রক্ষা করতে অবিলম্বে অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে হবে। দেশের প্রচলিত আইনে যেকোনো ধরনের জুয়া নিষিদ্ধ হলেও নানা কৌশলে অনলাইন জুয়ার প্রচার চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার সম্প্রচারমাধ্যমে, বিশেষ করে খেলাধুলার চ্যানেলসহ ডিজিটাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপনের রমরমা প্রচার চলছে। এসব বিজ্ঞাপনে দেশের ক্রিকেটারসহ শোবিজের কোনো কোনো অভিনেত্রীকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বস্ব খুইয়ে অত্মঘাতী হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। বলা বাহুল্য, অনলাইন জুয়ার এই বিস্তার রোধ করতে না পারলে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।

মানুষের ব্যক্তিগত গোপন তথ্য ফাঁসের দায় নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। এর ক্ষতি শুধু ব্যক্তির নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেও হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। তথ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব যাদের তারাই যদি তথ্য ফাঁসের সাথে জড়িত থাকে, তাহলে মানুষ কিভাবে নিরাপদ থাকবে? অথচ এদের সাথে যারা জড়িত এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের যথাযথ বিচার হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, এসব দায়িত্বে যারা থাকে, তারা দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়ায় ‘দলদাসে’ পরিণত হয়েছে। তাদের নীতি-নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ বলে কিছু থাকে না। সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের জিম্মাদার হয়ে তা নিয়ে ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছে। এদের কেন ধরা হয় না? অথচ একজন নোবেল লরিয়েটকে নানা অভিযোগে কতভাবেই না হেনস্তা করা হচ্ছে। অনলাইন জুয়া বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। এক বল্গাহীন পরিস্থিতি চলছে। কারো যেন কোনো দায়বোধ নেই। এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই চলতে দেয়া যায় না। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে বিস্তারিত আলোচনা করে এসব অপরাধ বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করা জরুরি। মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যপাচার, অর্থপাচার রোধ এবং সম্পদ রক্ষায় ডিজিটাল মাধ্যমের সুরক্ষা দিতে হবে। সাইবার গ্যাঙসহ যারাই এর সাথে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণ মানুষকেও অবৈধ পন্থা অবলম্বন করা থেকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সউদী পৌঁছেছেন ৩৪ হাজার হজযাত্রী

সউদী পৌঁছেছেন ৩৪ হাজার হজযাত্রী

প্রান্তিক পর্যায়ে দক্ষ এসএমই উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে

প্রান্তিক পর্যায়ে দক্ষ এসএমই উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে

বিনিয়োগ, অভিবাসন, মৌসুমি কর্মসংস্থান, প্রবাসী কল্যাণ, জ্বালানি বিষয়ে আলোচনা হবে : হাছান মাহমুদ

বিনিয়োগ, অভিবাসন, মৌসুমি কর্মসংস্থান, প্রবাসী কল্যাণ, জ্বালানি বিষয়ে আলোচনা হবে : হাছান মাহমুদ

ইরানের প্রেসিডেন্ট নিহত

ইরানের প্রেসিডেন্ট নিহত

একটুখানি শীতল পানি-১

একটুখানি শীতল পানি-১

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শোক

বিশ্ব নেতৃবৃন্দের শোক

বিশ্ব নেতৃবৃন্দের শোক

ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে বাংলাদেশের জনগণও শোকাহত

ইরানের প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে বাংলাদেশের জনগণও শোকাহত

ভারতের ‘জেরক্স ইন্ডিয়া’ হাতিয়েছে ১১২ কোটি

ভারতের ‘জেরক্স ইন্ডিয়া’ হাতিয়েছে ১১২ কোটি

দ্বিতীয় দিনেও তান্ডব অটোচালকদের

দ্বিতীয় দিনেও তান্ডব অটোচালকদের

ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ -ওবায়দুল কাদের

ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ -ওবায়দুল কাদের

তাপদাহ কেটে দেশজুড়ে বৃষ্টি

তাপদাহ কেটে দেশজুড়ে বৃষ্টি

পিকে হালদারসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন

পিকে হালদারসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন

কারান্তরীণের অমানবিক খেলায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সরকার -মির্জা ফখরুল

কারান্তরীণের অমানবিক খেলায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সরকার -মির্জা ফখরুল

দ্বিতীয় দফায় উপজেলা নির্বাচন আজ

দ্বিতীয় দফায় উপজেলা নির্বাচন আজ

নকল ডায়াবেটিস টেস্টিং স্ট্রিপ এক সপ্তাহের মধ্যে ধ্বংসের নির্দেশ

নকল ডায়াবেটিস টেস্টিং স্ট্রিপ এক সপ্তাহের মধ্যে ধ্বংসের নির্দেশ

নকল ডায়াবেটিস টেস্টিং স্ট্রিপ এক সপ্তাহের মধ্যে ধ্বংসের নির্দেশ

নকল ডায়াবেটিস টেস্টিং স্ট্রিপ এক সপ্তাহের মধ্যে ধ্বংসের নির্দেশ

ভারত থেকে ১২০০ কোটি টাকায় ২০০ বগি কিনছে রেলওয়ে

ভারত থেকে ১২০০ কোটি টাকায় ২০০ বগি কিনছে রেলওয়ে

নেতানিয়াহু ও হামাস নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দাবি

নেতানিয়াহু ও হামাস নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দাবি

ইসরাইলি আগ্রাসন ও ফাতাহ্র ব্যর্থতায় হামাসের প্রতি সমর্থন বাড়ছে

ইসরাইলি আগ্রাসন ও ফাতাহ্র ব্যর্থতায় হামাসের প্রতি সমর্থন বাড়ছে