ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

আয়োডিন ঘাটতিজনিত শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যা

Daily Inqilab ইনকিলাব

১১ মে ২০২৩, ০৮:৩৯ পিএম | আপডেট: ১২ মে ২০২৩, ১২:০২ এএম

আয়োডিন একটি রাসায়নিক পদার্থ যা আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাইরয়েড হরমোন তৈরি করতে সহায়তা করে। আমাদের শরীর নিজে আয়োডিন তৈরি করতে পারে না। তাই আমাদেরকে খাবারের সাথে বাইরে থেকে এটা গ্রহন করতে হয়।
আয়োডিনের উৎস:

বেশিরভাগ আয়োডিন আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য ও পানীয় থেকে পাই। সাধারণত সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে। তাই সামুদ্রিক উৎস থেকে প্রাপ্ত খাবার, যেমন সমুদ্রের মাছ, আয়োডিনসমৃদ্ধ হয়ে থাকে। কিছু শাকসব্জিতে, যেমন পালং শাক, বীট আলু, টমেটো ও মরিচে ভালমাত্রায় আয়োডিন থাকে যদি সেগুলো আয়োডিনসমৃদ্ধ মাটিতে জন্মে। আবার কিছু সব্জি আছে (যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম) যেগুলো শরীরে আয়োডিন শোষণে বাধা দেয়। ফলে, এসব সব্জি বেশি খেলে শরীরে আয়োডিনের মাত্রা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্বাদু পানিতে আয়োডিন খুব বেশি থাকে না। তাই স্বাদু পানির মাছেও আয়োডিন খুব বেশি থাকে না।

আয়োডিনের প্রয়োজনীয়তা
আমাদের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুত›েএর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য আয়োডিন প্রয়োজন। থাইরয়েড হরমোনের একটি অপরিহার্য উপাদান হলো আয়োডিন। থাইরোয়েড হরমোন আমাদের শরীরে বিপাক সংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে এবং শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। থাইরোয়েড হরমোন প্রধানত মস্তিষ্ক, মাংসপেশী, হৃৎপিন্ড, বৃক্ক, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সমূহের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে অপরিহার্য।

আয়োডিনের ঘাটতিজনিত সমস্যা
যখন আমাদের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি দেখা দেয় তখন প্রয়োজনীয় থাইরোয়েড হরমোন উৎপন্ন হয় না ত্রবং আমরা আয়োডিনের অভাব জনিত স্বাস্থ্যসমস্যায় ভুগি, এগুলিকে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত সমস্যা বা ইংরেজিতে আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি ডিজঅর্ডার (আইডিডি) বলা হয়ে থাকে। এসব সমস্যার কয়েকটি নিম্নরুপ:

হাইপোথাইরয়ডিজম: আয়োডিনের অভাবে যখন শরীরে পর্যাপ্ত থাইরোয়েড হরমোন তৈরি হয় না তখন তাকে হাইপোথাইরয়ডিজম বলা হয়। এর ফলে, আলসেমির ভাব, ঠান্ডা সহ্য করতে অক্ষমতা, অনিদ্রা, চামড়া শুস্ক হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।

গলগন্ড: আয়োডিনের ঘাটতির প্রাথমিক ও দৃশ্যমান লক্ষণ হলো গলগন্ড রোগ। আমাদের গলদেশে যে থাইরয়েড গ্রন্থি আছে তা যখন আয়োডিনের অভাবে ফুলে যায় তখন তাকে গলগন্ড রোগ বলা হয়। আগেই বলা হয়েছে, আয়োডিনের অভাবে আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয় না। এ-অবস্থায় থাইরয়েড গ্রন্থি শরীরের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অতিরিক্ত হরমোন তৈরি করার চেষ্টা করে। মুল উপাদান আয়োডিনের ঘাটতি থেকে যাওয়ার পরও যখন গ্রন্থিটি আয়োডিন তৈরির বৃথা চেষ্টা করে তখন তা আকারে বড় হয়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় এটি চোখে পড়ে না, কিন্তু ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে দৃশ্যমান হয়।

প্রজনন সমস্যা: গর্ভকালীন সময়ে থাইরোয়েড হরমোন শতকরা ৫০ ভাগ বেশি উৎপন্ন হয়। এই অতিরিক্ত থাইরোয়েড হরমোনের জন্য বেশি মাত্রার আয়োডিনের প্রয়োজন পড়ে। গর্ভধারণের ১১ সপ্তাহ থেকে ভ্রুণের থাইরোয়েড গ্র›্হি কাজ শুরু করে। ১৮ থেকে ২০ সপ্তাহ পূর্ণ হলে ভ্রুণ তার নিজস্ব থাইরোয়েড হরমোন উৎপাদন শুরু করে। সেই সময় থেকে শিশুর ৩ বছর বয়স পর্যন্ত সঠিক মাত্রার আয়োডিন গ্রহণ মা ও শিশু উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রুণের বৃদ্ধিও সময় মস্তিষ্ক এবং অ›এ খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ সময় আয়োডিনের অভাব হলে বা পর্যাপ্ত আয়োডিন না পেলে মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতিসহ আয়োডিন ঘাটতি জনিত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। আয়োডিনের খুব বেশি অভাব দেখা দিলে গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব কিংবা অপরিণত শিশুর জন্ম হতে পারে।এই সন্তান বেঁচে থাকলেও জন্মগত নানা সমস্যায় ভোগে। এর ফলে সন্তান হাবাগোবা হয়, ভালোভাবে কথা বলতে পারেনা কিংবা একেবারে বোবা হয়, কানে কম শোনে এবং শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ায় বামন আকৃতির থেকে যায়।

শিশু মৃত্যু: আয়োডিনের অভাবগ্রস্ত শিশুরা অন্যান্য শিশুর চাইতে বেশিমাত্রায় অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগে এবং তাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম থাকে। ফলে, তাদের মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি থাকে।

আয়োডিন গ্রহণের সঠিক মাএা নির্নয়:
আমরা সঠিক মাত্রায় আয়োডিন খাচ্ছি কি না তা পরিমাপ করা যায় প্রসাবের সঙ্গে নির্গত আয়োডিনের পরিমাণ থেকে। নানা রকম খাবারের মাধ্যমে আমরা যে আয়োডিন খাই তার শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি প্রসাবের সঙ্গে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। তাই প্রসাবে আয়োডিনের মাত্রা জানার মাধ্যমে বুঝতে পারি আমরা সঠিক পরিমাণে আয়োডিন খাচ্ছি কি না। একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্টির মানুষের শরীরে আয়োডিনের অবস্থা পরিমাপ করার জন্য তাদের প্রসাবে আয়োডিনের মাত্রা একটি ভালো সূচক হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রতি লিটার প্রস্রাবে গড়ে আয়োডিনের মাত্রা যখন ১০০-২০০ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায় তখন বুঝতে হবে শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি নেই।

বাংলাদেশের মাটি, ফসল ও মানুষের শরীরে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত সমস্যা
সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমানে যে আয়োডিন আছে তা সমুদ্র থেকে বাষ্প হয়ে মেঘের সাথে আকাশে উঠে যায়। বৃষ্টির মাধ্যমে তা মাটিতে এসে পড়ে। গাছপালা মাটি থেকে এই আয়োডিন শোষণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে অতিবৃষ্টি, বন্যা, ইত্যাদির কারণে মাটির এই আয়োডিন ধুয়ে আবার সমুদ্রে চলে যায়। এসব কারণে আমাদের দেশের মাটিতে ও ফসলে আয়োডিনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে, এখানকার মানুষের মধ্যে আয়োডিন ঘাটতির ঝুঁকি বেশি। বিশেষ করে বিস্তীর্ণ নদীর অববাহিকায় বসবাসরত জনগোষ্টির মধ্যে এই সমস্যা প্রকট, কারণ প্রায় প্রতিবছর বন্যার সময় এসব এলাকার ফসল উৎপাদনকারী জমিজমা পানিতে তলিয়ে যায়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় মাটি থেকে আয়োডিনও ধুয়ে চলে যায়।

২০০৪-২০০৫ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে: শিশুদের শতকরা ৬.২ ভাগ এবং মহিলাদের ১১.৭ ভাগ গলগন্ড রোগে আক্রান্ত। ১৯৯৩ সালে এই হার ছিলো যথাক্রমে শতকরা ৪৯.৯ ভাগ ও ৫৫.৬ ভাগ। ২০০৪-২০০৫ সালের সমীক্ষায় শিশুদের প্রস্রাবে আয়োডিন পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে ১৬২ মাইক্রোগ্রাম এবং মহিলাদের প্রস্রাবে ১৪০ মাইক্রোগ্রাম। ১৯৯৯ সালে এই মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৫৪ মাইক্রোগ্রাম ও ৪৭ মাইক্রোগ্রাম। ১৯৯৩ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী আয়োডিনের অভাব ছিল বাচ্চাদের মধ্যে শতকরা ৭১ ভাগ এবং মহিলাদের মধ্যে ছিল ৭০.২ ভাগ। ২০০৫ সালে এই হার নেমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৩৩.৮ ভাগ ও ৩৮.৬ ভাগে।

উপরোক্ত তথ্য থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এদেশে আয়োডিনের ঘাটতি লাঘবের জন্য গৃহীত জাতীয় প্রচেষ্টায় যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও এখনও আমাদের দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক আয়োডিনের ঘাটতিজনিত নানা সমস্যায় ভুগছে। ২০০৫ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী শিশুদের মধ্যে শতকরা ৪.০ ভাগ এবং মহিলাদের মধ্যে শতকরা ৪.৫ ভাগ আয়োডিনের চরম স্বল্পতায় ভুগছে। তাই আয়োডিনের এই ঘাটতি লাঘবে আমাদেরকে আরো বেশি সচেষ্ট হতে হবে।

প্রতিরোধের উপায়
আয়োডিনের এই ঘাটতিজনিত সমস্যা দূর করার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই খাদ্যের সাথে আয়োডিন গ্রহণ করতে হবে। এর সবচেয়ে ভালো এবং সহজ উপায় হলো আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া। আমাদের দেহে বেশি আয়োডিন জমা থাকেনা, তাই নিয়মিত অল্প পরিমাণে আয়োডিন গ্রহণ করতে হবে। আয়োডিনযুক্ত লবণ শুষ্ক স্থানে, সূর্যের আলো থেকে দূরে এবং আবদ্ধ পাত্রে রাখতে হবে। নতুবা লবণে আয়োডিনের পরিমাণ কমে যাবে।

ডা. শাহজাদা সেলিম
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ


বিভাগ : স্বাস্থ্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

ইত্তিহাদেই সিটিকে রুখে দিল ইন্টার

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

রোনালদোদের নতুন কোচ পিওলি

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

দক্ষিণ আফ্রিকাকে গুড়িয়ে আফগানদের ঐতিহাসিক জয়

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

যেই গৌরব কেবল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

রিট করে ‘খেলাপি ঋণ স্থগিত’ বন্ধ চান ব্যাংক-মালিকরা

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

বিদেশি ঋণ ফের ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

টাকা উদ্ধারের নামে ‘ঘুষ’ চাওয়ার অভিযোগ জিএম শাহজাহান চৌধুরীর’র বিরুদ্ধে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকতে হবে

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

৬০ হাজার টন ইউরিয়া সার কিনবে সরকার, ব্যয় ২৩৬ কোটি টাকা

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

আইকনিক লিডার তারেক রহমান ও বাংলাদেশের রাজনীতি

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের চক্রান্ত চলছেই

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

তারেক রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য ও দিকনির্দেশনা

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

ইসরাইলের দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসংঘের

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

উত্তপ্ত মণিপুরে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে নতুন করে গোলাগুলি

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২৭ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ভ্যারিয়্যান্ট

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

২০০ হাতি নিধনের সিদ্ধান্ত জিম্বাবুয়ের

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

কলেরাসহ মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে সুদানের ৩৪ লাখ শিশু

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

১১ হাজার ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর প্রাণ গেছে

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

বেলারুশে হামলা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে : লুকাশেঙ্কো

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান

তাইওয়ান প্রণালীতে চীনের যুদ্ধবিমান