শীতের এই ঠাণ্ডায় বয়স্কদের যা মানতে হবে
১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:১০ এএম

বাংলাদেশ ছয় ঋতুর দেশ। শীতকাল তার মধ্যে অন্যতম। শীতের তীব্রতা মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্মকে ব্যাহত করে। শীতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় বয়স্ক ও শিশুরা। আমরা সবাই জানি সেই প্রাচীন প্রবাদ ‘চিকিৎসা অপেক্ষা প্রতিরোধই শ্রেয়’। কিন্তু আমি কখনো কথাটি ভেবে দেখিনি বা এর ওপর গুরুত্বও দেইনি। গুরুত্ব দিলাম এবং সত্যটি উপলব্ধি করলাম যখন নিজে পরিস্থিতির শিকার হলাম। আমাদের দেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে বয়স্কজনিত রোগব্যাধিও। এই বয়সটাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। প্রকৃতিগতভাবেই বিভিন্ন রকম শারীরিক পরিবর্তনও আসে। ষড়ঋতুর এই দেশে বিভিন্ন সময় আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তনের সাথে তরুণ বা মধ্যবয়সীরা খাপ খাইয়ে নিতে পারলেও বয়স্কদের বেশ ভুগতে হয়। আর শীতকালে বয়স্কদের মধ্যে এর প্রকোপ বেশ গভীরভাবেই পরিলক্ষিত হয়। এ সময় শ্বাস-প্রশ্বাস, ত্বকের সমস্যাসহ নানা ধরনের অসুবিধা দেখা দেয় বয়স্কদের। তাই তাদের নেয়া দরকার বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।
শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা : শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা বা শ্বাসনালীর প্রদাহ বয়স্কদের খুবই কমন। এ ছাড়াও শীতে সাধারণ সর্দি, কাশি বা ফ্লু থেকে হতে পারে নিউমোনিয়া। যারা আগে থেকেই অ্যাজমা, ব্র্রংকাইটিস, সিওপিডি, এমফাইসিমা ইত্যাদি রোগে ভোগেন; শীতের সময় এসব সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য উচিত সব সময় গরম কাপড় পরিধান করা, গরম পানি পান ও ব্যবহার করা। নামাজের জন্য ওজুতে গরম পানি ব্যবহার করা উচিত। রুম গরম রাখার জন্য সম্ভব হলে রুম হিটার ব্যবহার করতে পারেন। ঠা-া আবহাওয়ায় ঘরের বাইরে যাওয়া কোনোমতেই উচিত নয়, বিশেষ করে যারা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। একান্ত প্রয়োজনে বাইরে যদি যেতেই হয়, যথেষ্ট পরিমাণ শীতের কাপড় পরিধান নিশ্চিত করতে হবে। মাথা ও কানের টুপি, মাফলার, হাতে উলের গ্লাভস ব্যবহার করা উচিত। যাদের অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট আছে তারা সব সময় ইনহেলার সাথে রাখুন এবং প্রয়োজন হলেই ব্যবহার করুন। খুবই বেশি সমস্যা হলে ঘরে নেবুলাইজার ব্যবহার করতে পারেন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা নিন।
গিরায় ব্যথা বা অর্থাইটিস : শীতে বয়স্কদের অনেকেই অস্টিওআর্থ্রাইটিস অস্টিওপরোসিস বা অন্যান্য হাড় ও অস্থিসন্ধির ব্যথায় ভোগেন। এমনকি অনেকের আগে থেকেই রিউমাটয়েড অর্থাইটিস, এনকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস, সারভাইকাল স্পন্ডাইলোসিস জাতীয় রোগ থাকতে পারে। এ ধরনের রোগীদের ব্যথার সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে। এর মূল কারণ শুধু শীত নয়, বরং শীতকালে কাজকর্ম, শরীরিক পরিশ্রম বা নড়াচড়া কম হয় বলে এ সমস্যাগুলো আরো বাড়ে। এর থেকে মুক্তির জন্য ঠা-া পরিহার করুন। সম্ভব হলে ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি, হাত-পা নড়াচড়ার মতো হালকা ব্যায়ামের অনুশীলন করতে হবে। এতে শরীরে তাপ উৎপন্ন হবে, শীত কম লাগবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
রেনোড ফেনোমেনন : তীব্র ঠা-ায় হাত-পায়ে অক্সিজেন সহ রক্ত কমে গিয়ে নীল হয়ে যাওয়াকে ‘রেনোড ফেনোমেনন’ বলে। হাত ও পায়ের আঙুলে রক্ত সরবরাহ কম হওয়ার কারণে এমন হতে পারে। সাধারণত ধূমপায়ী ও বাতরোগীদের এটি বেশি হয়। এর ফলে ত্বকে অস্বাভাবিক অনুভূতি হওয়া, রক্তপ্রবাহ সঠিকভাবে না হওয়া, হাতে এবং আঙুলে ব্যথা, কব্জি ফুলে যাওয়া, ত্বকের ক্ষত, মাংসপেশিতে ব্যথা ইত্যাদি হতে পারে। এমনকি ঠা-ায় আঙুলে ইসকিমিক আলসারও হতে পারে। একে ফ্রস্টবাইট বলে। যাদের এই সমস্যা হয়, তাদের উচিত মোজা পরিধান করা, গরম সেক দেয়া, ঘরেই হালকা মুভমেন্ট করা ও চিকিৎসকের নির্দেশনা মতো চলা। অবশ্যই ধূমপান পরিহার করেতে হবে। এসব রোগীর ঠা-া পানি ব্যবহার না করে, গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। যাদের এই সমস্যা হয়, তাদের উচিত মোজা ভালমত পরা, গরম সেঁক দেওয়া, ঘরেই হালকা মুভমেন্ট করা ও চিকিৎসকের নির্দেশনা মতো চলা। এসব রোগীর ঠা-া পানি ব্যবহার না করে গরম পানি ব্যবহার করতে হবে।
হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক : শীতে বয়স্কদের হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও বেশি থাকে। কারণ, শরীর থেকে গরম বের হতে পারে না, ঠা-ায় ধমনি সঙ্কুচিত হয়ে রক্ত চলাচলে বিঘœ ঘটায়। এ ছাড়াও রক্তের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। ফলে রক্ত সহজেই জমাট বেঁধে দেখা দেয় স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য গরম কাপড় পরিধান করতে হবে, গরম পানি পান ও ব্যবহার করতে হবে। ঘরে রুম হিটার ব্যবহার করা যেতে পারে। যারা অন্যান্য রোগে ভোগেন যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি। তাদের অবশ্যই এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বুকে ব্যথা অনুভব করলে তা আমলে এনে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
হাইপোথার্মিয়া : যখন শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়, তাকে হাইপোথার্মিয়া বলে। বয়স্কদের এ ঝুঁকি বেশি থাকে। বিশেষ করে শীতের সময় হাইপোথার্মিয়া হলে বিপাকীয় কার্যাবলি স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হয় না, শরীরে কাঁপুনি হয়, স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না, দিকভ্রান্ত হয়, হোঁচট খেতে থাকে, গতি ধীর হয়ে যায়, কথাবার্তা জড়িয়ে যেতে থাকে। পরবর্তীকালে শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃৎস্পন্দন আশঙ্কাজনক মাত্রায় কমে আসে। কোনো কোনো সময় জ্ঞান হারায় এমনকি মৃত্যুবরণও করতে পারে। এ সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য সব সময় গরম কাপড় পরিধান করতে হবে। গরম পানি পান, অজু বা গোসলের সময় অবশ্যই গরম পানি ব্যবহার করতে হবে।
চর্মরোগ : শীত এলেই কিছু চর্মরোগ নতুন করে আবির্ভূত হয়, যা গরমকালে খুব একটা দেখা যায় না। বিশেষ করে চামড়ার শুষ্কতা, চুলকানি, হাত-পা ফেটে যাওয়া, মুখ ও জিহ্বায় ঘা ছাড়াও নানা ধরনের চর্মরোগ বা খোসপাঁচড়া বেশি দেখা দেয়। এ ছাড়া ভাইরাসের কারণে মুখে জ্বরঠোসা, ফাঙ্গাসের কারণে ত্বকে ডার্মাটাইটিস, স্ক্যাবিস ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এই সময় বয়স্কদের বিশেষ যতœ নিতে হবে। কেননা এসব রোগের প্রবণতা তাদের বেশি থাকে। তাদের বিছানা বা পরনের কাপড় যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এক বিছানায় গাদাগাদি করে ঘুমানো উচিত নয়। ত্বকের সুরক্ষায় ময়েশ্চারাইজার যেমন ভ্যাসলিন, গ্লিসারিন, অলিভঅয়েল বা সরিষার তেল ব্যবহার করতে পারেন। গোসলের আগে নয়, গোসলের পর গা ভেজা ভেজা থাকতেই এগুলো ব্যবহার করা ভালো। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মানসিক সমস্যা : প্রবল শীতে অনেকেরই অবসাদগ্রস্ত হয়ে বিষণœতাসহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যা হতে পারে, যা সাধারণত প্রবীণ বা বৃদ্ধদেরই বেশি হয়। তখন তারা সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে শুরু করেন। ট্রমা ও বিষণœœতায় ভোগা এসব মানুষের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। এ সময় পরিবারের অন্য সদস্যদের তাদেরকে বেশি সময় দেয়া উচিত। বিশেষ করে তাদের নিয়ে একসাথে টেলিভিশন দেখা বা গল্প করা যেতে পারে। তারা যেন একা না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মোট কথা, পরিবারের সবারই উচিত তাদের উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করা।
আরো কিছু পরামর্শ :
শীতে বয়স্কদের শুধু মোটা কাপড় নয়, বরং আরামদায়ক গরম কাপড় পরাতে হবে।
তাদের ত্বক, ঠোঁট, হাত-পা, নখসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে বাঁচাতে বিভিন্ন ক্রিমসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করা উচিত।
সব সময় তাদের শোয়ার ঘরটির দিকে নজর দিতে হবে। বিছানা যেন শীতল না হয়ে যায়। ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাস এবং গরম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। মাঝে মধ্যে রুমহিটার ব্যবহার করা যেতে পারে।
অজু, গোসলসহ নানা কাজেও গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। এতে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকবে।
ভিটামিন ‘ডি’ শরীরের জন্য খুবই দরকার। যার মূল উৎস সূর্যের আলো। এর অভাবে অস্থিসন্ধি বা বাতব্যথা বাড়ে। তাই সম্ভব হলে বয়স্কদের প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ মিনিট রোদ পোহাতে হবে।
শীতের সময় রাতজাগা ক্ষতিকর। তাই দ্রুত শুয়ে পড়ার অভ্যাস এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
বয়স্কদের মদপান, ধূমপান, অতিরিক্ত চা, কপি পান থেকে বিরত রাখা উচিত।
শীতের শাকসবজি বিশেষ করে গাজর, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি এবং খাদ্যতালিকায় ভিটামিন-মিনারেল ইত্যাদি রাখতে হবে। সব সময় গরম খাবার পরিবেশন করুন।
পানি কম পান করলে কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্টসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ জন্য গরম পানি এবং কেমিক্যালমুক্ত ফলের রস পান করতে দিন।
শীতের সময় ডায়রিয়ার সমস্যাও বেড়ে যেতে পারে। এর থেকে মুক্ত থাকতে চাইলে বাসি খাবার খাবেন না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন। ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইনসহ প্রচুর পানীয় পান করুন ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
কিছু নিয়ম মেনে চললে শীতের এই সময়েও বয়স্করা অনেকটা সুস্থ থাকতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের দায়িত্বও খুবই জরুরি। সবশেষে এ সত্যটি মনে রাখুন- পরিমিত ও নিয়মিত আহার, শারীরিক ব্যায়াম, বিশ্রাম, নিদ্রা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুস্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত। তাই নিজের যতœ নিজে নিন, সুস্থ থাকুন নিত্যদিন।
লোকমান হেকিম
গবেষক-কলামিস্ট,
মোবাইল- ০১৭১৬২৭০১২০।
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

বাংলাদেশ ভ্রমণে মার্কিন সতর্কতা নিয়ে ‘ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর'

ই-ক্লাব ঈদ রিইউনিয়নে উদ্যোক্তাদের প্রাণের স্পন্দন

বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে নারী কোটা বাতিল হচ্ছে

উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকায় ‘অস্ট্রেলিয়া অ্যাপ্লিকেশন ডে’

কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

সিলেটে কর্মসংস্থান পাথর মিল জোন উচ্ছেদ নয়-আরিফুল হক চৌধুরী

নোবিপ্রবির সঙ্গে তুরস্কের নিগদে ওমর হলিসদেমির বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি স্বাক্ষর

বাংলাদেশ হয়ে সেভেন সিস্টার্সে যাওয়ার রেল প্রকল্প স্থগিত

চোরাই গরুর অনুপ্রবেশ ৩ বছরে রামুর গর্জনিয়া বাজারের দাম বেড়েছে ১০ গুন: ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক চাষী

সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি, খুব সজাগ থাকতে হবে : মির্জা ফখরুল

শেখ হাসিনার পক্ষে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গোপন সভার ভিডিও ফাঁস

সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচনেই ভালো ফল আসবে না: তোফায়েল আহমেদ

আইএমএফের ঋণের কিস্তিছাড় ইস্যু সমাধানে আশাবাদী গভর্নর

আটঘরিয়ায় চাঁদু মিয়াকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা

বিষফোড়া ইসরাইলকে প্রতিরোধ করতে হবে : গোলাম মোস্তফা

ডিসি নিয়োগে তিন কোটি টাকার ভুয়া চেক ইস্যুকারী সেই সোবেদ আলী অবশেষে গ্রেপ্তার

সমাবর্তন উপলক্ষে ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর সনদে স্বাক্ষর করছেন চবি ভিসি

সীতাকুণ্ডে মাজারের আধিপত্য নিয়ে দুই গ্রুপের দ্বন্দ, সংঘর্ষের আশঙ্কা

জাতীয় নাগরিক পার্টি ও খেলাফত মজলিসের আন্তঃদলীয় সংলাপে ৮ দফা ঐকমত্য

যৌনপেশার আইনি স্বীকৃতি কুরআন-সুন্নাহ’র পরিপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা