লিপ ইয়ার ও লায়লা
১০ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৩০ পিএম | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৪ এএম
৮ মে। থ্যালাসেমিয়া দিবসটিতে হিমেলের ব্যস্ততা অন্তহীন। সারাদেশে প্রায় সাতচল্লিশটি স্বেচ্ছা রক্তদান প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের বিশেষ পুরস্কারটি থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য উৎসর্গ করেছিল মঞ্চেই। গতবছরের কথা। আজ লিপিয়ারা লায়লার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। ব্যস্ততার মাঝেই বিয়োগ বিষাদকে ভুলে থাকে। স্মৃতি তবুও উঁকি দেয় ব্যস্ততাকে ঠেলে। আট বছর আগের কথা জীবন্ত হয়ে ওঠে।
হিমেল লায়লাদের বাড়ির গেটে এসে যারপরনাই বিস্মিত হল। ভাবছে, এত বড় বাড়ির মেয়ে অথচ, তার চাল-চলনে এতটাই সাদামাটাভাবÑ কিছুতেই কিছু মেলাতে পারছে না। আমন্ত্রিত হয়ে আজই প্রথম এল এ বাড়িতে। উপলক্ষ্য জন্মদিন। সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও এসেছে। অবশ্য ওদের প্রায় সবাই বড়লোকের আদুরে ছেলেমেয়ে। হিমেল ভাবছে আমি হতভাগাই কেবল হতদরিদ্র। বেশ কয়েকটা টিউশনি করে। অনার্স ফাইনালও এগিয়ে এসেছে। টিউশন মিস করতে চায় না বলে নিমন্ত্রণে আসতে চায়নি। তবুও লায়লা আর বন্ধুদের জোরাজুরিতে আসতেই হল।
সদর গেট পেরিয়ে বড় লেন। দুপাশে হরেক রকমের ফুল গাছ, টবও আছে। মাঝখানে দামি লাল ছোট ইটের তৈরি নকশা করা আঁকাবাঁকা ইংরেজি বর্ণ ভি আকৃতির নদীর ঢেউয়ের মতো রাস্তাটি বাড়ির মূল গেটে গিয়ে থেমেছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে একপাশে গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা অন্য পাশে কিং সাইজের এ্যাকুরিয়াম। তাতে রঙ-বেরঙের নুড়ি পাথর আর জলজ গাছের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য ছোট বড় মাছের জলকেলি দেখে এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় সমুদ্রের নিচে নেমে এসেছে। মুগ্ধ হয়ে দেখল কিছুক্ষণ। স্যার, ওপরে ওঠার সিঁড়িটা ওইদিকে বলে দেখিয়ে দিল উর্দি পরা একজন। কোন কথা না বলে ওপরে উঠে গেল। বিশাল হলরুম। ওপরে ঝাড়বাতির আলোয় রুমটা ঝলমল করছে। দু’ধরনের দামি সোফা, বুকসেলফ, কর্ণার আর নান্দনিক সব সবুজ গাছের টবে সাজানো। দেখলেই মনটা জুড়িয়ে যায়। রুচির প্রশংসা না করে পারে না। সব বন্ধুরা যখন আনন্দে মাতোয়ারা, তখন হিমেল ভেতরে ভেতরে মনঃপীড়ায় ভুগছে। কেউ কেউ সোফায় বসে গল্পে মশগুল। নিচতলা গ্যারেজ, দু’তলা হল কাম ড্রয়িংরুম আর বাকি তিন আর চারতলা বসবাসের জন্য। দরজার পাশে দাঁড়িয়েই থাকল হিমেল। আর আনমনে ভেবে চলেছে বছর দুই আগের কথা। কেমন করে লায়লাদের মতো উচ্চবিত্তদের সাথে তার বন্ধুত্ব হল। স্টুডেন্ট কমন রুম, ক্লাসরুম, সেমিনার, লাইব্রেরি এমনকি ক্যান্টিনেও লায়লা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসত। রোজ একই স্টাইলে কোমর অব্দি লম্বা চুল একটি বেনি করে বাঁ-পাশে এনে বুকের ওপর ঝুলিয়ে রাখত। পোশাকেও বড়লোকি হাবভাব নেই। চুপচাপ, শান্ত স্বভাবের। নিচুস্বরে ধীরে ধীরে কথা বলত। বলত কম, শুনত বেশি। সবকিছুতেই কেমন একটা নিরুত্তাপ, নিরুদ্বেগ ভাব। ক্লাসের প্রথম দিন থেকেই লক্ষ করছিল হিমেল। ওদিকে হিমেল বেশ পড়–য়া, চঞ্চল, বাঁচালও খানিকটা। ওর একটি অদ্ভুত গুণ হল, প্রথম দেখাতেই যে কাউকে সে রিড করতে পারে, মেমরি প্রচুর শার্প তার। হবে নাই-বা কেন? জীবনে তো প্যারা কম যায়নি। ধাক্কা খেতে খতে পাক্কা হয়ে গেছে ঝুনো নারকেলের মতো। হিমেল আর পরশ পা-ে খুব ভালো বন্ধু। পরশ ভালো আঁকিয়ে আর খুব ভালো ক্রিকেটারও। হিমেল লায়লার একধারা চালচলন লক্ষ করলেও পরশ এসব নিয়ে স্টাডি করেনি। একদিন হিমেল লায়লার বিষয়টি বললে, পরশও পরপর বেশ ক’দিন লক্ষ করল ব্যাপারটি ঠিকই। হিমেল পরশের সাথে প্ল্যান করে লায়লা যেসব জায়গায় যে চেয়ারে বসে হিমেল আগে থেকেই সে চেয়ারটায় বসবে। পরদিন লায়লা ক্লাসে ঢুকতেই দেখে তার চেয়ারটি ফাঁকা নেই। ক্লাসে না ঢুকে ব্যাক করল। এরপর প্রতিদিনই হিমেল আর পরশ মিলে ক্যান্টিন, কমনরুম, সেমিনার এমনকি যাত্রী ছাউনিতেও ঠিক ওর চেয়ারটির দখল নিত। লায়লা প্রায় দেড় সপ্তাহ ভার্সিটিতে এল না। এবার মন খারাপ হল হিমেল আর পরশের। ব্যাপারটা আসলেই খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ঠিক করল, ওকে সরি বলবে। দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেল অথচ আজও লায়লা না।
তুই-ই বা অত ভাবছিস কেন? ছাড় না। এলে তো সরি বলেই নেব। বলল পরশ। কথা হচ্ছিল ক্লাসরুমের সামনে রেলিং-এ দাঁড়িয়ে। সেকেন্ড ক্লাস। স্যার আসছেন দেখে তারা ক্লাসে ঢুকতে যাচ্ছে। এমন সময় দেখে স্যারের পেছনে লায়লাও আসছে। খুশি হল ওরা। একে অন্যের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে সরি বলার বিষয়টিকে নিশ্চিত করল। লায়লা এবার আগের জায়গাটি ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও একেবারে পেছনের একটি জায়গায় বসল। লায়লা স্থির করেই নিয়েছে সে এখন থেকে পেছনের দিকেই বসবে। সামনের জায়গা নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা চলে। পেছনের জায়গার কোনো প্রতিযোগী নেই, থাকেও না। ওদিকে হিমেল আর পরশের মনটা খারাপ হল। ওরা প্রথম বেঞ্চের ডান কোণার সিটটি খালিই রেখেছিল তার জন্য। ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারল না কেউই। পরের ক্লাস অফ আছে। অফ ক্লাসে সবাই যে যার কাজ কেউ কেউ আড্ডা, কেউ লাইব্রেরি ওয়ার্ক, কেউ ক্যান্টিনে বা কমনরুমে-সেমিনারে কাটায়। লায়লা সেদিন কোথাও না গিয়ে মিথিলার খাতা থেকে বিগত ক্লাসগুলোর টাস্ক টুকে নিচ্ছিল। হিমেল আর পরশের ডিস্টার্বেন্স এড়ানোর জন্যে ক্লাসেই থেকে গেল। দু’দিন ধরে সুযোগ খুঁজছিল হিমেল আর পরশ ওকে সরি বলার জন্য। আজ সে একাই আছে এই সুযোগে যাবে কিনা ভাবছে হিমেল। আজ আবার পরশটা আসেনি। একা বলতে গেলে যদি অপমানিত হতে হয় ইত্যাদি নানাকিছু ভাবছে আবার মনঃপীড়াতেও ভুগছে হিমেল। সাত-পাঁচ ভেবে মনে জোর নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেই লায়লা দাঁড়িয়ে ব্যাগ গোছাতে লাগল। হিমেলকে আসতে দেখেই লায়লা বলল, কী? আজ থেকে আবার এই জায়গায় বসবে না কি? ওর অমন আকস্মিক কথায় আরও হতচকিয়ে গেল হিমেল।
সরি টু ডিস্টার্ব ইউ লায়লা। ওভাবে বলে আর প্লিজ লজ্জা দিও না। সেসব কিছুই করতে আসিনি। ভুলের জন্য সরি বলতেই এসেছি। ভূমিকা না রেখেই দ্রুত মাথা নিচু করে বলে ফেলল হিমেল।
সরি কেন? দোষটা তো আমারই? তাই আমারই তোমাদের সরি বলা দরকার ছিল। আ’ম সরি। আমার মনে রাখা উচিত ছিল, পাবলিক প্লেসের কোনো নির্দিষ্ট জায়গাকে নিজের মতো ব্যবহার করাটা ঠিক হয়নি। সরি এগেইন, ফর দেট। একনাগাড়ে সবকথা বলে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল লায়লা। সে চায় না এ ইস্যু নিয়ে দ্বিতীয়বার আবার তার মুখোমুখি হতে হয়।
হিমেল বরারবই দুষ্টু কিন্তু খুব জলি। সারা ক্লাস মাতিয়ে রাখে একাই। সেদিনের পর প্রায় পনেরো দিন পেরিয়ে যায়। হিমেল আসে না। ওকে ছাড়া ক্লাসগুলো ঠিক জমে না। মিস করে প্রায় সবাই। লায়লা চিন্তিত হয়। পরশের কাছে জানতে পারে মায়ের অসুস্থতার জন্য বাড়ি গেছে। হিমেল খুব নিডি ফ্যামিলির ছেলে। ভ্যানচালক বাবার অকালমৃত্যুতে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে অন্যের জমি চাষ করে, ভ্যান চালিয়ে এবং টিউশনি করে। এভাবেই সংসার চালিয়ে নিজের ও ছোটবোনের পড়ার খরচও জোগান দেয়। এমন সংগ্রাম করছে ক্লাস নাইন থেকে। মা কাঁথা সেলাই, হাতপাখা, কাপড়ের ও মাটির তৈরি টেপা পুতুল ইত্যাদি বানিয়ে মৌসুমি অল্প কিছু আয় হত। সেই মা-ও অকালে চলে গেল একদিনের জ্বরে। দিশেহারা হিমেল ক্লাস সেভেনে পড়া ছোটবোনের নিরাপত্তা নিয়ে। বয়োবৃদ্ধা দাদি ছাড়া তাদের আর কেই নেই। মেসের বড়ভাই ফুটবল টিম জিতে যে নয় হাজার টাকা পেয়েছিল তাই হিমেলকে মায়ের চিকিৎসার জন্য দিয়েছিল। নিতে চায়নি। মাস ফুরোয়নি বলে টিউশনির টাকাও পায়নি। অগত্যা নিতেই হলো পরে শোধ দেবে এমন শর্তে বড়ভাইকে রাজি করিয়ে। তবুও রক্ষা হলো না শেষটা। মায়ের মৃত্যুর কথা শুনে মেসের পাঁচজনই গিয়েছিল হিমেলকে সান্ত¦না দিতে।
এদিকে আজই তার অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার ফরম ফিলাপের লাস্ট ডেট। লায়লার মনে হিমেলের প্রতি মায়া এবং একইসাথে তার শেষ কথোপকথনের জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবছে। পরশের কাছ থেকে সবকথা শুনে লায়লা হিমেলের ফরম ফিলাপের সব ব্যবস্থা করল। তার পর থেকে হিমেল আর পরশও লায়লার বেস্ট ফ্রেন্ডসের তালিকায় যুক্ত হলো। যে লায়লার বড়লোক বন্ধুরা তাকে দূরে রাখত গরিব বলে, ওকে ব্যঙ্গ করে মেল ট্রেন বলে খ্যাপাত আজ তারাই ওর পরম বন্ধু হয়ে উঠেছে।
এক তোড়া ফুল আর ছোট একটি গিফটবক্স হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে হিমেল। পরশও তার পেছনেই। অপেক্ষায় থাকা লায়লা ওকে দেখামাত্রই দ্রুতপায় কাছে গিয়ে হাত ধরে সোফায় বসাল। খুব সংকোচে বসল। শাদা গাউনে পরির মতো লাগছে লায়লাকে। চার বছর পর পর মানে লিপ-ইয়ারে জন্মদিন হয় বলে এদিনের আয়োজনে কোনোকিছুর খামতি রাখে না তার বাবা-মা। দিনের সাথে মিল রেখে নামও রেখেছে লিপিয়ারা, ডাক নাম লায়লা। এত আলোর ঝলকানি, এত আনন্দ কোলাহল, এত ¯িœগ্ধ সাজেও লায়লাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সেদিনই জানতে পারে লায়লা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। সব আনন্দ বিষাদে রূপ নেয় হিমেল ও পরশের। বাকিরা জানত। ঠিক তার পরের জন্মদিনেই লায়লা মাত্র বত্রিশ বছরে মৃত্যুবরণ করে। অকৃতদার হিমেলের বয়স এখন ষাট ছুঁই ছুঁই। ‘আমরা হব রক্তদাতা, করব জয় মানবতা’ এই স্লোগানে ‘লায়লা ফাউন্ডেশন’ নামের প্রতিষ্ঠানটিই তার ঘর-সংসার-প্রেমিকা।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান