বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথ এবং আগামীর বাস্তবতা
১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম
বলতে কোনো দ্বিধা নেই, বৈশাখ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং আমাদের সাহিত্য। সম্ভবত বাংলা ভাষায় এমন কোনো কবি, ছড়াকার কিংবা সাহিত্যিক নেই যিনি বৈশাখ নিয়ে কিছু না কিছু লিখেননি। এই যেমন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাই ধরা যাক। তিনি বৈশাখ নিয়ে এতো বেশি লিখেছেন যে, তাকে বৈশাখের কবি বললেও অত্যুক্তি হবে না। বলা বাহুল্য তার জন্মও এই বৈশাখ মাসে। হয়তো এই কারণে বৈশাখের প্রতি কবির রয়েছে অন্যরকম এক আত্মিক টান। এখানেই শেষ নয় তার কবিতায় বৈশাখ এবং বাংলা নববর্ষ এসেছে বহুমাত্রিকতার দ্যোতনায়-সুরে, ছন্দে, রূপ, রস, গন্ধ এবং স্পর্শে। তিনি বৈশাখের যতগুলো রুপ আছে তার প্রতিটি রুপকেই দেখেছেন নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। ‘বৈশাখ আবাহন’ কবিতায় তার এই বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার রূপ দেদীপ্যমান : ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/ তাপসনিঃশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/ যাক পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি/অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক।’
এই ‘বৈশাখ আবাহন’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের বৈশাখ নিয়ে লেখা সর্বাধিক পঠিত একটি কবিতা অথবা গান। অবশ্য বৈশাখ নিয়ে সর্বাধিক পরিচিত ও পঠিত ছড়াটির রচয়িতাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।; ছড়াটি হচ্ছে : ‘আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’
এই বৈশাখ-কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবলোকন করেছেন রুদ্ররূপেও। কল্পনা কাব্যের ‘বৈশাখ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রুদ্র বৈশাখ ভিন্ন আমেজে ধরা দিয়েছে। কবি লিখেছেন, ‘হৈ ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,/ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল/ তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল/ কারে দাও ডাক/ হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?’ রবীন্দ্র কাব্যে বৈশাখকে ঘিরে এমনি আরও অনেক সমৃদ্ধ লেখা আজও আমাদের ভাবায়, চিন্তা চেতনা এবং অনুপ্রেরণা দেয়।
একথা বিসংবাদিত যে প্রত্যেক জাতি, গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়কে আলাদা করে রাখে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। তাদের নিজস্ব চিন্তা, চেতনা, ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। সেদিক থেকে আমাদের বাঙালি জাতিসত্ত্বারও আলাদাভাবে পরিচয় দেওয়ার মতো বৈশিষ্ট্য ম-িত অনেক উপাদান এবং উপাচার রয়েছে। এই সমস্ত উপাদানের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। যদিও এই বাংলা নববর্ষ এবং আমাদের বাঙালিপনা নিয়েও হাজারো প্রশ্নের অবতারণা রয়েছে। আর এইসব প্রশ্নের অবতারণার মোক্ষম সুযোগও আমরাই আমাদের আচার আচরণের মাধ্যমে করে দিয়েছি। এই বিষয়টিকে বুঝানোর জন্য একটি উদাহরণ দিতে চাই। আশাকরি বিষয়টিকে অনুভব করার জন্য এই একটি উদাহরণ-ই যথেষ্ট হবে।
আমরা বাঙালিরা তা বাংলাদেশী হই কিংবা পশ্চিম বঙ্গের হই... প্রতি বছর আমরা দুইটি নববর্ষ পালন করে থাকি। একটি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের ধারক পহেলা বৈশাখ এবং অন্যটি পহেলা জানুয়ারি তথা ইংরেজি নববর্ষ। এখন মনে মনে একটিবার ভাবুন তো দেখি, এই দুইটি নববর্ষ উদযাপনের ক্ষেত্রে কোনটিতে আমরা অধিক আনন্দিত থাকি, অধিক প্রাণবন্ত থাকি, অধিক পুলকিত থাকি। এই নিয়ে একটি আলাদা সচিত্র প্রতিবেদন বা গবেষণা হওয়ার প্রয়োজন বলে আমি করি।
আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণের আলোকে বলতে চাই, পশ্চিম বঙ্গের কথা বলতে চাই না ; অন্তত বাংলাদেশে পাবলিকলি ইংরেজি নববর্ষ বাংলা নববর্ষের চেয়ে অধিক সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়। বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্মের মাতামাতি যেন আকাশ ছোঁয়া। থার্টি ফাস্ট নাইটের নামে সারারাত ধরে চলতে থাকে আতশবাজি, ফটকা এবং আরও অনেক অশ্লীল উদযাপন। সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত হয় কনসার্ট। উদ্দাম নৃত্য আর বিদেশি মদের ধুমা তালে ক্যাসিনো গুলো আকাশে উড়তে থাকে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে আয়োজন করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠান। যদিও এসব কিছুই রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হয় না। তবুও কি রাষ্ট্র কিংবা আমরা কেউ এর দায় উপেক্ষা করতে পারব? পারব না। অন্যদিকে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক বাহক পহেলা বৈশাখ উদযাপন হয় কিছুটা ম্রিয়মাণ ভাবে। বিশেষভাবে পহেলা বৈশাখ আসলে মাথার উপর ঝুলতে থাকে সাম্প্রদায়িক শক্তির খড়গ হস্ত। শুরু হয় ভয় এবং আতংক। নিরাপত্তা কর্মীরা ডগ স্কোয়াড নিয়ে কাজে নেমে পড়েন। সারাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়। আমার প্রশ্ন হল, কেন? নিজেদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের লালন হবে, ধারণ হবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়?
এরচেয়েও বড় আতংকের বিষয় আছে। আর সেটা হল, যদিও আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে থাকি; তবে তা কেবলই লৌকিকভাবে, বাহ্যিকভাবে। প্রশ্ন হল, আমাদের অন্তর, আমাদের মন, মানস, ভালোবাসা এতে কতটা জড়িয়ে থাকে? আমার কাছে মনে হয়, অনুষ্ঠান সর্বস্বতা ছাড়া এই ক্ষেত্রে আমাদের অন্তরের তেমন একটা যোগসূত্র নেই। এই যোগসূত্র না থাকার একটি প্রমাণ দিতে চাই। আর তা হল, কিছুদিন পূর্বে অনার্স চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার ভাইভা নিচ্ছিলাম। একটা কমন প্রশ্ন প্রায় সবাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আজ বাংলা মাসের কত তারিখ? অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কেউ এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি। এরচেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে আমি জানি না। অথচ আমরা নিজেকে বাঙালি বলে গৌরব কামাই!
তবুও আমরা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করব। করতেই থাকব। কারণ এটা বঙ্গাব্দের প্রথম দিন তথা বাংলা নববর্ষ। বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে সাড়ম্বরে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশে জাতীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়। সে হিসেবে এইদিনটি বাঙালি জাতির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে পরিগণিত। বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের শুরু হয়েছিল পুরান ঢাকার মুসলিম মাহিফরাস সম্প্রদায়ের হাতে। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্র-সৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। এছাড়াও দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়। এই উৎসবটি শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করা হয়। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হল “শুভ নববর্ষ”। নববর্ষের সময় বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ২০১৬ সালে, ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করে। যা বাঙালি জাতিসত্তা হিসাবে আমাদের জন্য একটি গৌরবের বিষয়।
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো। তাই খাজনা আদায়ে সুষ্ঠু বিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।
তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় অর্থাৎ ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ সাল থেকে। মজার ব্যাপার হলো, প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে ‘বঙ্গাব্দ’ তারপর বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। মোটামুটি এই হলো বাংলা নববর্ষ শুরুর দিককার ইতিহাস। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হবে, আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রকারান্তরে আমরা যেভাবে আমাদের অফিস আদালত থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে ইংরেজি সাল তথা খ্রিস্টাব্দকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছি, তাতে আমার আতংক হয় যে, আমরা অচিরেই আমাদের আবেগের জায়গাটি হারিয়ে ফেলতে পারি অথবা ইতোমধ্যে অনেকটা হারিয়ে ফেলেছি। যা বাংলা নববর্ষ এবং ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের ধারাপাত থেকেই বুঝা যায়। তবে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, পহেলা বৈশাখকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এখনো আমাদের হাতে বেশ কিছুটা সময় বাকি আছে। সে ক্ষেত্রে এখনই সচেতন মহলকে এগিয়ে আসবে হবে এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম
সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত