তরবারির জোরে ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি

Daily Inqilab মুনশী আবদুল মাননান

৩০ মার্চ ২০২৩, ১১:৩৫ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১২ পিএম

এক শ্রেণির ইতিহাস লেখক বলার চেষ্টা করেছেন, ভারতে ইসলামের প্রচার-প্রতিষ্ঠা ঘটেছে তরবারির জোরে। মুসলিম অভিযানকারীরা ভারতে একের পর এক অভিযান চালিয়েছেন এবং হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে স্থানীয়দের বাধ্য করেছেন ইসলাম গ্রহণে। কখনো প্রলোভনে বশীভূত করেও ইসলামে ধর্মান্তর করেছেন। শাসকরাও একই কাজ করেছেন।

এ অভিমত বা অভিযোগের সঙ্গে প্রকৃত সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম মানে শান্তি। বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাই ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় বলপ্রয়োগ ও প্রলোভনের কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। কালপ্রবাহে বিশ্বের সর্বত্র ইসলাম প্রচারিত হয়েছে, কোনো কোনো মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছে। কিন্তু কোথাও জোর-জবরদস্তি করে, ভয় দেখিয়ে কিংবা অত্যাচার-নির্যাতন করে কাউকে মুসলমান করা হয়নি। প্রলোভন দেখিয়েও করা হয়নি। জবরদস্তি কিংবা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তর ইসলাম সমর্থন করে না। মদীনায় মুসলমানদের প্রথম রাষ্ট্র পৌত্তলিক, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সঙ্গে চুক্তি করে গঠিত হয়েছিল। সেখানে নাগরিক হিসেবে সবারই ছিল সমানাধিকার। কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল না। এক সম্প্র্রদায়ের ওপর অন্য সম্প্রদায়ের অত্যাচার-নির্যাতনের অবকাশ ছিল না। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে: ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। সূরা বাকারা: ২৫৬। আরো বলা হয়েছে: তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার। সূরা: কাফিরুন: ৬। ইসলামে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁর রাসূলকে (সা.) উদ্দেশ্য করে বলেছেন: প্রচার করা ছাড়া রাসূলের অন্য কোনো কর্তব্য নেই। সূরা মায়িদা: ৯৯। প্রচার করাই নবী-রাসূলদের কাজ। প্রতিষ্ঠার কোনো বাধ্যবাদকতা তাদের নেই। এরপরও ইসলামের প্রচার-প্রতিষ্ঠা তরবারির জোরে হয়েছে, তা কীভাবে ধারণা করা যায়? বিশ্বের সব দেশ ও জনপদে ইসলাম যেভাবে প্রচার-বিস্তার লাভ করেছে, ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

ভারতে মুসলমান অভিযানকারী বা রাজ্যপ্রতিষ্ঠাকামীদের আগমনের অনেক আগেই ইসলাম এসেছে। ঐতিহাসিকরা একমত: ইসলামের আবির্ভাব বহু আগে থেকেই ভারতের সঙ্গে আরবের যাতায়াত, যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মালাবার ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। এই বাণিজ্যকেন্দ্রের সূত্রেই সেখানে আরব বসতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আরবে মহানবী (সা.) এর আবির্ভাব ও ইসলাম সম্পর্কে তারা সম্যক অবহিত ছিল। অনেকে তখনই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত তার ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন: মালাবার উপকূলে ইসলাম ধর্মের উৎপত্তির আগে থেকেই আরব বণিকদের বসতি গড়ে উঠেছিল। বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির জন্য শান্তি, শৃঙ্খলা বজায় রাখা তারা বিশেষ জরুরি মনে করত এবং দেশের শাসকদেরও এ ব্যাপারে সাহায্য করত। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে আরব বণিকদের অসদ্ভাবের কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। এর থেকে ধরে নেয়া যায় যে, নিতান্ত বাস্তব কারণেই উভয়ের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি ছিল। পরে এই আরবরা ইসলাম গ্রহণ করে। তখন থেকে তারা পরিচিত হয় মুসলমান বলে।

সুরজিৎ দাশগুপ্ত আরো লিখেছেন: আরব বণিকরা যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং সেই ইসলামকে কেরলে নিয়ে আসে, কেরলস্থিত তাদের পরিবারবর্গের মধ্যে ইসলাম প্রচার করে তখন এই বণিকদের স্থানীয় কর্মচারিরাওÑ যাদের একটা বড় অংশ বণিকদের জন্য কায়িক পরিশ্রম করতÑ ইসলাম ধর্মের আদর্শ ও বদান্য সম্বন্ধে জানতে পায়। তারা জানতে পায় এমন এক শাস্ত্রের কথা, যাতে বলা হয়েছে, মানুষকে আলাদা আলাদা জাতিতে জন্ম দেয়া হয়েছে বটে, কিন্তু জন্ম দিয়ে নয়, মানুষের বিচার হয় তার স্বভাব-চরিত্র দিয়ে। (৩৯, ১৩-১৫)। বর্ণভেদ প্রথা জর্জরিত, মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত কেরলের জনসাধারণ ইসলাম ধর্মের মধ্যে মানুষ হিসেবে বাঁচার ডাক শুনতে পেল।

তার মতে, এই ডাক তাদের কাছে একেবারে অচেনা নয়, বৌদ্ধ ধর্ম কেরলে একদা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তখন তারা এই ডাক শুনেছিল। তখন তারা মানুষের মতো বাঁচত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে পরিস্থিতির পরিবর্তন সূচিত হয় এবং পঞ্চম শতাব্দী নাগাদ বৌদ্ধ ধর্মকে উৎখাত করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মই সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠে ও সমাজের সর্বস্তরে তার কঠোর বিধান শাসনকে অমোঘরূপে প্রতিষ্ঠা করে। এই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে উচ্চ আধ্যাতিকতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল জনসাধারণের বৃহত্তর অংশকে অপমান, ঘৃণা ও শোষণ করার সামাজিক সমর্থনÑ প্রকৃত পক্ষে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগামিতা ও উদারতা এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিচিত্রতর প্রতিক্রিয়াশীলতা ও সংকীর্ণতা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অন্তর্নিহিত বিরোধ। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ব্যবহারিক দিকগুলোর চাপে কেরলের জনসাধরণ যখন মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় ভুলতে বসেছে, তখনই তাদের কাছে ইসলাম ধর্মের আগমন ও আহ্বান। এই আহ্বানে তারা প্রচন্ড উৎসাহে সাড়া দিল এবং ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করল। ‘তুহফৎ-উল মুজাহিদ্দীন’-এর লেখক জৈনুদ্দিন লিখেছেন, ‘যদি কোনো হিন্দু তখন মুসলমান হতো তাহলে অন্যরা তাকে এই (নি¤œবর্গ জন্মের) কারণে ঘৃণা করত না, অন্য মুসলিমদের সঙ্গে যে রকম বন্ধুত্ব নিয়ে মিশত, তার সঙ্গে সেভাবেই মিশত। মানুষের মূল্য পাবে, সমাজে মানুষের মতো ব্যবহার পাবেÑ এটা ছিল ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রধান কারণ।

সুরজিৎ দাশগুপ্তের এই বক্তব্যের আলাদা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। স্পষ্টতাই বোঝা যায়, তৎকালে ভারতে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মে সাধারণ মানুষের কোনো মূল্য ছিল না। উচ্চবর্ণের মুষ্টিমেয় কিছু লোক দ-মু-ের অধিকর্তা ছিল এবং নি¤œবর্ণের বিপুল সংখ্যক মানুষকে তারা দাসের মতো যথেচ্ছ ব্যবহার করতো। তারা ছিল শোষিত, বঞ্চিত, নিগৃহীত ও অবহেলিত। পক্ষান্তরে ইসলাম ছিল শান্তি, সমতা, মর্যাদা, সম্মান ও ভ্রাতৃত্বের নিশ্চয়তাকারী মতাদর্শ। বলা বাহুল্য, ভারতেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও ইসলাম প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামের আপন বৈশিষ্ট্য ও গুণেই। (চলবে)


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সোনাইমুড়ী প্রেসক্লাব নির্বাচনে ইনকিলাব সংবাদদাতা বেলাল ভৃঁইয়া সভাপতি ও ইয়াকুব সেক্রেটারি নির্বাচিত

সোনাইমুড়ী প্রেসক্লাব নির্বাচনে ইনকিলাব সংবাদদাতা বেলাল ভৃঁইয়া সভাপতি ও ইয়াকুব সেক্রেটারি নির্বাচিত

জম্ম না দিয়ে বাবা হওয়া যায় তার দৃষ্টান্ত প্রমাণ আবু ইউছুফ চৌ:

জম্ম না দিয়ে বাবা হওয়া যায় তার দৃষ্টান্ত প্রমাণ আবু ইউছুফ চৌ:

সাতক্ষীরায় স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে নিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মহত্যা!

সাতক্ষীরায় স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে নিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মহত্যা!

চিলমারীতে সাপের কামড়ে প্রাণ গেলো কৃষকের

চিলমারীতে সাপের কামড়ে প্রাণ গেলো কৃষকের

তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে স্কুল-কলেজ সাত দিন বন্ধ

তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে স্কুল-কলেজ সাত দিন বন্ধ

ফেসবুকে ভিডিও বার্তা: সম্পদ নিয়ে সংবাদ প্রসঙ্গে যা বললেন বেনজীর

ফেসবুকে ভিডিও বার্তা: সম্পদ নিয়ে সংবাদ প্রসঙ্গে যা বললেন বেনজীর

দেশে নিবন্ধিত নিউজ পোর্টালের সংখ্যা ২১৩টি : তথ্য প্রতিমন্ত্রী

দেশে নিবন্ধিত নিউজ পোর্টালের সংখ্যা ২১৩টি : তথ্য প্রতিমন্ত্রী

ইরানের প্রেসিডেন্টকে সোমবার স্বাগত জানাবে পাকিস্তান

ইরানের প্রেসিডেন্টকে সোমবার স্বাগত জানাবে পাকিস্তান

গুগল না মেটা, ‘ভারচুয়াল ভোটযুদ্ধে’ শেষ হাসি হাসল কে?

গুগল না মেটা, ‘ভারচুয়াল ভোটযুদ্ধে’ শেষ হাসি হাসল কে?

প্রথম প্রান্তিকে চীনের অনলাইন খুচরা বিক্রি ৩.৩ ট্রিলিয়ন ইউয়ান

প্রথম প্রান্তিকে চীনের অনলাইন খুচরা বিক্রি ৩.৩ ট্রিলিয়ন ইউয়ান

তাপদাহরে কারণে প্রাথমকি বিদ্যালয়ে অ্যাসম্বেলি বন্ধ স্কুল ও খেলা চলবে

তাপদাহরে কারণে প্রাথমকি বিদ্যালয়ে অ্যাসম্বেলি বন্ধ স্কুল ও খেলা চলবে

বেসরকারি খাতে নাগরিকের তথ্য ভান্ডার তুলে দেয়া সংবিধান পরিপন্থী : রুহিন হোসেন প্রিন্স

বেসরকারি খাতে নাগরিকের তথ্য ভান্ডার তুলে দেয়া সংবিধান পরিপন্থী : রুহিন হোসেন প্রিন্স

সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে গণঅধিকার পরিষদের বিক্ষোভ

সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে গণঅধিকার পরিষদের বিক্ষোভ

বিদায়ী ঈদযাত্রায় ৩৯৯ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ১৩৯৮ জন আহত : যাত্রী কল্যাণ সমিতি

বিদায়ী ঈদযাত্রায় ৩৯৯ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ১৩৯৮ জন আহত : যাত্রী কল্যাণ সমিতি

পাঁচবিবিতে পুকুরের পানি সেচ দিতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু

পাঁচবিবিতে পুকুরের পানি সেচ দিতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু

ভোলা থেকে ছেড়ে যাওয়া কর্ণফুলী ৩ যাত্রীবাহি লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড।

ভোলা থেকে ছেড়ে যাওয়া কর্ণফুলী ৩ যাত্রীবাহি লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড।

তিনি ঘুঘু দেখেছেন, ঘুঘুর ফাঁদ দেখেননি আইভীকে হেফাজত নেতা মাওলানা আবদুল আউয়াল

তিনি ঘুঘু দেখেছেন, ঘুঘুর ফাঁদ দেখেননি আইভীকে হেফাজত নেতা মাওলানা আবদুল আউয়াল

দিন ও রাতের তাপমাত্রা বাড়তে পারে : আবহাওয়া অধিদপ্তর

দিন ও রাতের তাপমাত্রা বাড়তে পারে : আবহাওয়া অধিদপ্তর

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ

উপজেলা পরিষদ : ডিসি-এসপির সঙ্গে ইসির বৈঠক ২৫ এপ্রিল

উপজেলা পরিষদ : ডিসি-এসপির সঙ্গে ইসির বৈঠক ২৫ এপ্রিল