মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়-১

Daily Inqilab মুনশী আবদুল মাননান

০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:১৯ এএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১২ পিএম

ভারতের সঙ্গে আরবের কোনো বিরোধ বা শত্রæতা ছিল না। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক ও মানবিক সম্পর্ক বরং মধুরই ছিল। আরবে ইসলামের আবির্ভাব হলেও এ সম্পর্কের মধ্যে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। আরব সাগরের ভারতীয় উপকূলীয় এলাকায় ইতোমধ্যে অনেক মুসলমান বসতি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় অনেকে ইসলাম গ্রহণও করেছে। বিরোধ দেখা দিয়েছিল অর্ধশতাব্দী পরে ৭০৮ সালে, যখন একটি মুসলিম জাহাজবহর সিন্ধুর দেবল বন্দরের কাছে আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হলো এবং জাহাজবহরের যাত্রী নারী-পুরুষ, ব্যবসায়ী, হাজি অপহৃত হলো। জাহাজবহরে ৮টি জাহাজ ছিল বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন। জাহাজগুলোতে সিংহলের রাজার, যিনি আগেই ইসলাম গ্রহণ করেন, প্রেরিত খলিফার জন্য বিভিন্ন উপঢৌকনও ছিল। ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বিষয়টি অবগত হয়ে সিন্ধুর রাজা দাহিরকে এক পত্রের মাধ্যমে কৈফিয়ত তলব করেন এবং অপহৃত সকলকে ফেরত দেওয়ার দাবি জানান। রাজা দাহির হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পত্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব দেন। এতে ক্ষুব্ধ হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের অনুমতি নিয়ে রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। দুটি অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর মুহম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্ব ৭১২ সালে যে অভিযান প্রেরণ করেন, তা সফল হয়। মুহম্মদ বিন কাসিম একে একে দেবল, মেরুন, সেহোরান, রাওর, ব্রাহ্মণাবাদ, আলোর, মূলতান প্রভৃতি জয় করেন। এই প্রথমবারের মতো ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা মুসলিম অধিকার আসে। পরবর্তী প্রায় তিনশ বছর ভারতে মুসলামনদের আর কোনো সামরিক অভিযান প্রেরিত হয়নি।

ভারতের কোনো কোনো ইতিহাস লেখক মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযান প্রসঙ্গে বলেছেন, বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে এবং তাদের ছলে-বলে-কৌশলে ধর্মান্তরিত করা ইসলামের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার যুগে অন্যায় বলে গণ্য হতো না। (ভারতজনের ইতিহাস, শ্রী বিনয় ঘোষ)। জিহাদ ও ধর্মান্তরের লক্ষ্যে মুহম্মদ বিন কাসিম ভারতে অভিযান চলান, এটা ঠিক নয়। মুসলিমদের জাহাজবহর আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হওয়া এবং যাত্রীদের অপহৃত হওয়া সিন্ধু অভিযানের প্রত্যক্ষ কারণ। আরো কারণ আছে। যেমন, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ যখন পারস্যের সঙ্গে যুদ্ধেরত, তখন রাজা দাহির তার শত্রæদের সাহায্য করেন। দ্বিতীয়ত, হাজ্জাজ বিন ইউসুফের শাসনকালে পারস্যের কিছু বিদ্রোহী ভারতে পালিয়ে এলে রাজা দাহির তাদের আশ্রয় দেন। তৃতীয়ত, মুহম্মদ বিন কাসিমের আগে যে দুটি সামরিক অভিযান রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে প্রেরিত হয়, তাতে মুসলমানরা পরাজিত হলে যুদ্ধবন্দীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।

প্রশ্ন হলো, বর্ণিত কারণগুলোর প্রেক্ষিত মুসলমানদের ভারতে সামরিক অভিযান চালানো কি অপরিহার্য হয়ে যায় না?
কারণগুলো থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়, খেলাফতের সংহতি ও নিরাপত্তা বিধানের তাকিদ এবং রাজা দাহিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের সমুচিত জবাব হিসেবেই মুহম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুতে সামরিক অভিযান চালান ও বিজয় লাভ করেন। মুহম্মদ বিন কাসিমের সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৬ হাজার। সংখ্যায় কম হলেও সৈন্যরা ছিল দক্ষ, অভিজ্ঞ, সাহসী ও বিচক্ষণ। তাছাড়া অভিযানে ভারতীয় জাঠ ও মেড সম্প্রদায় প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে। তারাও ছিল বলিষ্ট ও সাহসী। তারা রাজার দ্বারা অত্যাচারিত ও নিগৃহীত ছিল। মুহম্মদ বিন কাসিম অসাধারণ বীরই ছিলেন না, ছিলেন উদার, সহৃদয় ও মানবিক গুণাবলীর অধিকারী। বিজিতদের প্রতি তিনি ছিলেন ¯েœহপ্রবণ। আল বিরুনী তার ভারতত্তত্ত¡ বইতে লিখেছেন: কোথাও যুদ্ধ করে, কোথাও সন্ধি দ্বারা তিনি অভিষ্ট সিদ্ধ করেন এবং যারা ধর্ম পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক তাদের ছাড়া অন্য সকলকে নিজ নিজ ধর্ম আচরণে প্রতিষ্ঠিত করলেন।

সিন্ধু বিজয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভ‚মিকা সব থেকে বেশি। তিনিই এই বিজয় অভিযানের পরিচালক, নির্দেশক ও তত্ত¡াবধায়ক। মুহম্মদ বিন কাসিম ছিলেন তার ভাতিজা ও জামাতা। তাকেও তিনিই মনোনীত করেন। অনেকেই অবগত আছেন, হাজ্জজ বিন ইউসুফ অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সাহাবীসহ লক্ষধিক লোকের হত্যার জন্য তাকে দায়ী করা হয়। সেই তিনিই ছিলেন অত্যন্ত উঁচু স্তরের একজন সুশাসক ও ন্যায়বিচারক। মুহম্মদ বিন কাসিমের অভিযানালীন সময়ে তিনি নিয়মিত পত্রের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিতেন। মুহম্মদ বিন কাসিমও পত্রের মাধ্যমে দিক নির্দেশনা চেয়ে পাঠাতেন। এমনি এক চিঠিতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহম্মদ বিন কাসিমকে নির্দেশ দেন: যেহেতু বিজিতরা এখন আমাদের জিম্মি, অতএব তাদের জীবন ও সম্পত্তিতে আমাদের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই। সুতরাং, তাদের আপন আপন উপাস্যের মন্দির গড়তে দাও। স্বধর্ম পালনের জন্য কেউ যেন বাধা বা শাস্তি না পায়, স্বদেশে সুখে-স্বাচ্ছন্দে বসবাসে তাদের যেন কেউ বাধা না দেয়।

ব্রাহ্মণাবাদ জয়ের পর মুহম্মদ বিন কাসিম প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করার এক পর্যায়ে এলাকার পূজারীরা তার কাছে এসে বলে, মন্দিরে হিন্দুদের আসা-যাওয়া কমে গেছে। মন্দিরগুলো মেরামত হয়নি। তারা তাদের আয় রোজগারের ক্ষতিপূরণ ও মন্দির মেরামতের অনুরোধ জানায়। এ ব্যাপারে কী করণীয়, জানতে চেয়ে মুহম্মদ বিন কাসিম হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পত্র লেখেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার পত্রে লেখেন: তোমার পত্র পড়ে জানতে পারলাম, হিন্দুরা তাদের মন্দির মেরামত করতে চায়, তারা যেহেতু আনুগত্য মেনে নিয়েছে, কাজেই নিজেদের উপাস্য দেবতার পূজা করার অধিকার তাদের পাওয়া উচিত। কারো উপর কোনো ধরনের বল প্রয়োগ করা উচিত নয়।

এ নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মুহম্মদ বিন কাসিম এই ঘোষণা জারি করেন: যে সব লোক বাপ-দাদার ধর্মকর্মের অনুসারী তাদের ধর্মকর্ম পালনে পূর্ণ অধিকার দেওয়া হলো। কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। তারা আগে ব্রাহ্মণদের অনুদান ইত্যাদি যেভাবে দিতো, এখনো দিয়ে যাবে। নিজেদের মন্দিরে তারা স্বাধীনভাবে পূজা করবে। সরকারি রাজস্ব থেকে শতকরা তিনভাগ ব্রাহ্মণদের জন্য বরাদ্দ থাকবে। ব্রাহ্মণরা যখন চায় তাদের মন্দির মেরামত ও প্রয়োজনীয় আসবাব ক্রয়ের জন্য অর্থ চেয়ে নিতে পারেন।

মুহম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু অধিকারের পর সব কিছুই পূর্বের মতো বহাল রাখেন। ধর্মকর্ম, মন্দির, পেশাÑ কোনো ক্ষেত্রেই কোনো পরিবর্তন আনেননি। প্রথম দিকে মুখ্য প্রশাসনিক পদগুলোতে নিজের মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়োগ করলেও পরে এর পরিবর্তন সাধন করেন। আগে যেসব হিন্দু কর্মকর্তা যে যে পদে ছিলেন সে সে পদেই তাদের পুনর্বহাল করেন। এমনকি ব্রাহ্মণদের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে পর্যন্ত নিয়োজিত করেন। তিনি গোটা দেশে সমতার নীতি, সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল অভূতপূর্ব। তিনি সুযোগ-সুবিধা সকলের মধ্যে এমনভাবে বণ্টন করেন যে, হিন্দুদের অনেকেই স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, খলিফা দ্বিতীয় ওমরের আমলে (৭১৭-৭২০) রাজা দাহিরের পুত্র জয়সীমাসহ কয়েকজন হিন্দু রাজা ইসলাম গ্রহণ করেন। তাদের সঙ্গে জনসাধারণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশও ইসলামে দীক্ষিত হয়। ভয়ভীতি, জোর-জবরদস্তি কিংবা প্রলোভনে পড়ে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন এমন প্রমাণ ইতিহাসের কোথাও নেই। (চলবে)

 

 


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে এলজিইডির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে এলজিইডির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

আগামীকাল বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনঃ ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

আগামীকাল বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনঃ ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

রাইসির এমন মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন মুসলিম বিশ্ব

রাইসির এমন মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন মুসলিম বিশ্ব

রাইসির মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে হামাসের বিবৃতি

রাইসির মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে হামাসের বিবৃতি

আধুনিক যুদ্ধেও কেন রাশিয়া দেড়শো বছরের পুরনো মোর্স কোড ব্যবহার করছে?

আধুনিক যুদ্ধেও কেন রাশিয়া দেড়শো বছরের পুরনো মোর্স কোড ব্যবহার করছে?

রাইসির মৃত্যুকে ‘ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার’ বললেন ইহুদি পুরোহিতরা

রাইসির মৃত্যুকে ‘ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার’ বললেন ইহুদি পুরোহিতরা

লামায় শেষমুহুর্তে জমে উঠেছে ভোটের লড়াই

লামায় শেষমুহুর্তে জমে উঠেছে ভোটের লড়াই

ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন আমার প্রিয় একটি ভাই : এরদোগান

ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন আমার প্রিয় একটি ভাই : এরদোগান

কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কের বেহাল দশা।। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা

কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কের বেহাল দশা।। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা

নোয়াখালীর হাতিয়াতে ৩০ কেজি হরিণের গোশত জব্দ

নোয়াখালীর হাতিয়াতে ৩০ কেজি হরিণের গোশত জব্দ

জরুরি বৈঠক ডেকেছে ইরানের মন্ত্রিসভা

জরুরি বৈঠক ডেকেছে ইরানের মন্ত্রিসভা

রাঙ্গামাটিতে চলছে ইউপিডিএফের সড়ক ও নৌপথ অবরোধ

রাঙ্গামাটিতে চলছে ইউপিডিএফের সড়ক ও নৌপথ অবরোধ

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের স্থানে তাপের উৎস খুঁজে পেল তুর্কি ড্রোন

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের স্থানে তাপের উৎস খুঁজে পেল তুর্কি ড্রোন

রাইসিকে সর্বোচ্চ পদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল

রাইসিকে সর্বোচ্চ পদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল

ইরানের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার

ইরানের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার

প্রথম ভারতীয় হিসাবে ‘গ্লোবাল ডিসরাপ্টর্স’ তালিকায় দীপিকা

প্রথম ভারতীয় হিসাবে ‘গ্লোবাল ডিসরাপ্টর্স’ তালিকায় দীপিকা

মাগুরায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রকৌশলী তাপস নিহত

মাগুরায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রকৌশলী তাপস নিহত

রাইসির মৃত্যুতে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট ‘গভীরভাবে শোকাহত’

রাইসির মৃত্যুতে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট ‘গভীরভাবে শোকাহত’

এখনও খোঁজ মিলেনি সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের

এখনও খোঁজ মিলেনি সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের

কে এই ইরানি প্রেসিডেন্ট রাইসি?

কে এই ইরানি প্রেসিডেন্ট রাইসি?