ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-৯

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

০৭ জুন ২০২৪, ১২:১২ এএম | আপডেট: ০৭ জুন ২০২৪, ১২:১২ এএম

হুমায়ুন নামের মানে হলো ভাগ্যবান। কিন্তু হুমায়ুনের বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন নিয়ে সন্দেহ করতে পারেন যে কেউ। বাবরের রেখে যাওয়া সাংগঠনিকভাবে দুর্বল প্রশাসন ব্যবস্থায় হুমায়ুন পড়লেন প্রবল ও অপ্রতিহত চাপে। পশ্চিমে বাহাদুর শাহ, পূর্বে শেরশাহ হুমায়ুনকে হতবুদ্ধি করে ছাড়েন। বাবরের জীবিত চার পুত্রের কেউই হুমায়ুনের সহোদর ছিলেন না। হুমায়ুনের মা আলাদা, হিন্দালের মা আলাদা এবং কামরান ও আসকারী ছিলেন আরেক মায়ের সন্তান। অবশ্য এক সহোদরা বোন ছিলেন হুমায়ুনের; গুলবদন বেগম। ভাইদের বৈরিতা হুমায়ুনের ক্ষমতাকে করেছে বিপন্ন। টানা বিশ বছর যুদ্ধ করতে হয়েছে কামরানের বিরুদ্ধে। নির্বাসনের সময়টাও ছিলো শত্রুতায় তিক্ত। যদিও শেষ অবধি আসকারী ও কামরানের পতন ঘটেছে। হিন্দাল অবশ্য শেষ জীবনে হুমায়ুনের আনুগত্যে মরণকে বরণ করেন।
কিন্তু হুমায়ুন একেবারে সৌভাগ্যবঞ্চিত ছিলেন না। ভাগ্য তাঁর সহায়তায় নিয়োজিত করেছিলো স্ত্রী হামিদা বানু এবং বন্ধু বৈরাম খাঁকে। হুমায়ুনের কল্যাণে তিনি ছিলেন নিবেদিত ও নিষ্ঠাবান। বিচক্ষণতায় ছিলেন অতুলনীয়, সাহসিকতায় অনন্য। তার হাত ধরে হুমায়ুনের রাজত্ব আবারো প্রত্যাবর্তন করে দুর্ভাগ্যের কালোরাত পাড়ি দিয়ে। হামিদা বানু পরম মমতায় আগলে রাখেন দুঃসময়ের প্রহারে জর্জরিত হুমায়ুনকে। হুমায়ুন সংসার বিরাগী হতে চেয়েছেন বারবার। হামিদা বানু আশা ও আশ্বাস দিয়ে তাকে টেনে এনেছেন প্রত্যাবর্তনের সড়কে।
ছোট্ট একটা জীবন পেয়েছিলেন হুমায়ুন, যার ব্যাপ্তি ছিলো ৪৮ বছর। এর মধ্যে সিংহাসনে থেকেছেন তিনি দশ বছর। প্রথম পর্যায়ে ৯ বছর সাড়ে চার মাস এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬ মাস। এই সময়টা ছিলো অস্থিরতায় কম্পমান। ফলে শাসনব্যস্থা সংগঠনের দিকে খুব একটা দৃষ্টি দেবার ফুরসত পাননি হুমায়ুন।
তবুও সুশাসক ছিলেন তিনি। তার শাসনের নীতিসূত্র বেঁধে দিয়েছিলো পিতার শেষ ওসিয়ত। এর উপর অক্ষরে অক্ষরে কাজ করেছেন তিনি। সেই নীতি ও সূত্রের সারকথা হলো উদারতা, প্রজাকল্যাণ ও অসা¤প্রদায়িকতা। বাবরবাহিত রাজকীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সুলতান ছিলেন যিল্লুল্লাহ বা আল্লাহর ছায়া। সুলতানী আমলেও এই ভাবধারা জারি ছিলো। আল্লাহর প্রতিপালন নীতির অনুসরণ করবেন সুলতান। কী সেই প্রতিপালন নীতি?
তিনি সাদা-কালো, ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলিম, নারী-পুরুষ, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সবার লালন-পালন করেন। সবার প্রয়োজন পূরণ করেন। সুলতানকে তা-ই করতে হবে। সকল প্রজাকে দেখতে হবে সমান দৃষ্টিতে। আমীর শ্রেণী ছিলেন সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে। এর সাথে ছিলেন প্রশাসনিক, বিচারিক ও প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্রের লোক হিসেবে তারা ছিলেন বিবেচিত। তাদের ছিলো তিনটি বিভাগ। প্রথমত, আহলে দাওলাহ। এরা রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক কর্মকান্ড, অর্থনীতি, করব্যবস্থা ইত্যাদির দেখভাল করতেন। এদের মধ্যে সবার উপরে ছিলেন উজির বা মন্ত্রীগণ। এর পরে ছিলেন রাজপরিবারের স্তর অনুযায়ী আত্মীয়গণ। এর পরে ছিলেন আমীর বা প্রাদেশিক শাসকগণ। আর ছিলেন সেনাকর্তা ও সেনাবাহিনী। উজিরদের সমন্বয়, আমিরদের সাথে যোগাযোগ ও নির্দেশনা, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, সৈন্য ভর্তি, তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ ও পরিশোধ ইত্যাদি কাজ আঞ্জাম দিতো এই বিভাগ। এই বিভাগের প্রত্যেক ধাপে ছিলো দায়িত্ব ও জবাবদিহির কঠোর শৃঙ্খল। মেধা, দক্ষতা আর বীরত্বের মধ্য দিয়ে এখানে নিজেকে প্রমাণ করতে হতো। কিন্তু এই ব্যবস্থার সুফল নির্ভর করতো প্রতিটি চাকার একত্রে থাকার উপর। হুমায়ুনের সময় যেহেতু বহু আমীর বিদ্রোহ করেন, রাজপরিবারেও বিদ্রোহের আগুন জ্বলে, ফলে এই শৃঙ্খলা ভালোভাবে কাজ করেনি।
হুমায়ুনের আহলে দৌলত বিভাগের নির্বাহী কর্তা ছিলেন আমীর হিন্দু বেগ। তিনি জৈনপুরের গভর্নর ছিলেন, আবার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী ছিলেন। বাবরের আমলেও এই হিন্দু নির্বাহীর পদমর্যাদা ছিলো উচ্চতর। নিজ সাম্রাজ্যের হিন্দুদের প্রতি খুব ভালো ব্যবহার করতেন হুমায়ুন। তিনি তাদের পুরস্কৃত করতেন বিভিন্ন সময়ে। নিজের দরবারের নাম রাখেন ‘শৃঙ্গার মÐপ। তাঁর হাতিদের নামকরণ করেন সব সংস্কৃতে।
প্রশাসন ব্যবস্থার দ্বিতীয় স্তরে ছিলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও প্রতিভ‚গণ। তাদেরকে বলা হতো আহলে সায়াদত বা সৌভাগ্যধারী শ্রেণী। শিক্ষক, শাস্ত্রজ্ঞ, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, কবি, আইনবিদ, স্থপতি, জ্যোতির্বিদ প্রমুখের অবস্থান ছিলো এখানে। হুমায়ুন জ্যোতির্বিদ্যায় আসক্ত ছিলেন। ভাগ্য গণনা করাতেন ঘনঘন। এর প্রতি তার ছিলো আস্থা। আবার দরবেশ শ্রেণীর প্রতি তাঁর ভক্তি ছিলো প্রগাঢ়। মুসলিম সৈয়দ এবং হিন্দুদের যোগী ও সাধকগণ পেতেন বিশেষ সম্মান। এই বিভাগের নির্বাহী কর্তা ছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন মুহাম্মদ ফারগানী। এই বিভাগের লোকেরা নিজেদের জ্ঞান ও আদর্শ বিনিময়ের মাধ্যমে রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি করতেন। সামাজিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, বিশেষত নৈতিক ও জ্ঞানগত উন্নয়ন, শিক্ষা-দীক্ষার বিস্তার ও উন্নয়ন এবং আলেম ও পÐিত শ্রেণীর প্রয়োজন পূরণ, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রসমূহে তাদের নিয়োগ ও বেতন-ভাতা ইত্যাদির দেখভাল করতো এই বিভাগ।
সাম্রাজ্যের তৃতীয় শ্রেণীতে ছিলেন আহলে মুরাদ। সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে যুক্ত মানুষ তারা। গায়ক, কুস্তিগীর, বিনোদনকর্মী, নৃত্যশিল্পী, আর্টিস্ট থেকে নিয়ে নানা ধারার শিল্পকর্মীরা এতে যুক্ত ছিলেন। এই বিভাগের নির্বাহী কর্তা ছিলেন আমীর মুহাম্মদ ওয়াইস।


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা