তাসাওউফ জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন হাসান আবদুল কাইয়ূম

Daily Inqilab মো: বশির হোসেন মিয়া

১৯ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

বছরের বিশেষ দিনগুলোতে পত্রিকার পাতায় দৃষ্টি রাখলে যে নামটি পাঠকের হৃদয়কে আন্দলিত করে, শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় অশ্রুসিক্ত হয়, তিনি হলেন এদেশের ইসলাম প্রিয় মানুষের রাহবার, রসুল প্রেমিকদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর তাসাওউফ জগতের এক উজ্জ¦ল নক্ষত্র অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম। তিনি ছিলেন বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, মুফাসসিরে কুরআন, সাহিত্যিক, গবেষক, বিশিষ্ট কলাম লেখক, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও দ্বারিয়াপুর শরীফের (মাগুরা) প্রয়াত গদ্দীনশীন পীর। পুরো নাম হযরত মওলানা শাহ সূফী আলহাজ আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল কাইয়ূম। আজ ৬ অক্টোবর তাঁর তৃতীয় ওফাত বার্ষিকী।

তিনি ২০২০ সালের এই দিনে দুরারোগ্য ব্যধি করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

১৯৪৪ সালের ৩০ এপ্রিল বর্তমান মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার দ্বারিয়াপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত পীর পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ফুরফুরা শরীফের প্রখ্যাত পীর মুজাদ্দীদে যামান আমীরুশ শরীয়ত হযরত মওলানা শাহ সূফী আলহাজ আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলাইহির অন্যতম প্রধান খলিফা হযরত মওলানা শাহ সূফী আলহাজ তোয়াজউদ্দীন আহমদ (রহ) এবং মাতা বাংলার তাপসী রাবেয়া খ্যাত মোছাঃ জোহরা খাতুন (রহ)।
অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূমের শ^শুর ছিলেন যশোরের খড়কী শরীফের প্রখ্যাত পীরে কামেল হযরত মওলানা শাহ সূফী আবদুল মতিন (রহঃ)। তিনি ছিলেন তাঁর বড় জামাতা। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই মনীষী ছিলেন মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান। তাঁর বড় ভাই আবুল বাশার মুহাম্মদ আবদুল হাই (রহ), যিনি শৈশবেই দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন।

ছোটবেলায় তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি মা মোছাঃ জোহরা খাতুনের কাছে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় দ্বারিয়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছাত্র অবস্থায় তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি পিতার কাছে ইলমে তাসাওউফের শিক্ষা গ্রহণ করেন।

এরপর খুলনা বিকে ইনস্টিটিউট ও মাগুরা হাই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা সরকারি ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের মাদ্রাসা শিক্ষায় চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে জেনারেল শিক্ষা লাভের জন্য তিনি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জগন্নাথ কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৭০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ঐ বিষয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৬৬ সালে পিতা সূফী তোয়াজউদ্দীন আহমদ (রহ) তাঁকে উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক শিক্ষা ইলমে লাদুন্নীর ছবক দেন। আর যারা এ ছবক লাভ করেন তারা আল্লাহ প্রদত্ত নিগুঢ় জ্ঞানের অধিকারী হন।

তাঁর পেশাগত জীবন শুরু হয় কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে। অধ্যাপক কাইয়ূম ১৯৮০ সালে জানুয়ারি মাসে ইসলামিক ফাউন্ডেশন-এর সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করে খুব অল্প দিনেই পরিচালক পদে উন্নীত হন এবং ২০০২ সালে সফলতার সাথে কর্মজীবন শেষ করে অবসর নেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত অবস্থায় তাঁর মাধ্যমে ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যেমন-তাফসিরে তাবারি, বুখারি শরিফ, ইসলামী বিশ্বকোষ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ইসলামি বিশ্বকোষে তাঁর অনেকগুলো মৌলিক ও অনূদিত প্রবন্ধ রয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হলো অনুপম আদর্শ, ফুরফুরার চাঁদ, প্রসঙ্গ ইসলাম, ইসলাম ও জীবন, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, খোকা-খুকুর ছড়া, কাদেরিয়া তরিকা, তা’লীমে তাসাওউফ, সাবির কাব্যে ইসলামী ভাবধারা। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘অগ্রপথিক’, শিশু পত্রিকা ‘সপ্তডিংগা’ ও সাহিত্য সাময়িকী ‘ঐতিহ্য’-এর সম্পাদক ছিলেন তিনি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ছয় সহস্রাধিক। তিনি তাঁর পিতার স্মরণে আঞ্জুমানে তোয়াজিয়া নামে একটি জনকল্যাণ মূলক সংস্থা গড়ে তুলেছেন। দ্বারিয়াপুর শরিফে তিনি গড়ে তুলেছেন আঞ্জুমানে তোয়াজিয়া নামে একটি ইয়াতিমখানা।

ইসলামের সৌন্দর্য্যকে তিনি সবসময় সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। বিশেষ করে মীলাদ-কিয়াম ও ঈদে মীলাদুন্নবী (সাঃ)-এর ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার এবং রসূল (সাঃ)-এর শান মান মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে ছিলেন আপোষহীন। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে ফানাফিস শায়েখ ও ফানাফির রসূল।

তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছয় বার পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী (সাঃ) উপলক্ষে বিশ্ব পীরদের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি ও হিন্দী ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ইত্তেফাক, ইনকিলাব, জনকন্ঠ, ডেইলি সানসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ধর্মীয় বিষয়ে তিনি কলাম লিখতেন। ১৯৮০’র দশক থেকে তিনি ইত্তেফাক পত্রিকায় নিয়মিত মাহে রমজানের ওপর লিখতেন।
তাঁর তৃতীয় ওফাত বার্ষিকিতে নিকট আত্মীয়, ভক্ত, অনুরাগী ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলেমগণ তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করছে।

পীর-মুরীদীতে কম সময় দিলেও ছয় সহস্রাধিক প্রবন্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখির মাধ্যামে তিনি জ্ঞানপিপাসুদের তৃষ্ণা নিবারণ করেছেন। তিনি আরো অবদান রেখেছেন বেতার-টেলিভিশন বক্তৃতা ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনার মাধ্যমে।

তাঁর পিতা যুগশ্রেষ্ঠ অলিয়ে কামেল সূফি তোয়াজউদ্দীন আহমদ (রহ) তাঁকে ১৯৮৭ সালে ফুরফুরা শরীফ নিয়ে যান এবং ২৫ ডিসেম্বর ফুরফুরার মেজলা হুজুর মুফতীয়ে আযম বাংলা ও আসাম পীর আল্লামা আবু জাফর মুহাম্মদ অজীহউদ্দীন মুস্তফা সিদ্দিকী সাহেবের হাত দিয়ে তাঁকে দেয়া তাঁর আব্বা হুজুর কিবলা (রহ)-এর খেলাফতনামা, পিরহান ও পাগড়ী হস্তান্তর করেন।

১৯৯২ সালের ১৬ জুন হুজুর কিবলা (রহ)-এর ইন্তেকালের পর অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম তাঁর পিতার স্থলাভিষিক্ত (কায়েম মাকাম) হন এবং আমৃত্যু গদ্দীনশীন পীর হিসেবে দ্বারিয়াপুর শরীফে তাঁর ওপর অর্পিত দ্বায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, প্রয়াত গদ্দীনশীন পীর সাহেব ২০০৭ সালে সস্ত্রীক হজ্জ্বব্রত পালনের সময় হুজুর (সাঃ)-এর রওজা মোবারকের সামনে তাঁর একমাত্র সাহেবজাদা আরিফ বিল্লাহ মিঠুকে খিলাফতের স্মৃতিস্বরূপ পাগড়ী পরিয়ে দেন এবং তাঁর অবর্তমানে দ্বারিয়াপুর শরীফের গদ্দীনশীন মনোনীত করেন। ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর পিতার ইন্তেকালের পর থেকে অদ্যবধি আলহাজ শাহ আবুল মন্যর মুহাম্মদ আরিফ বিল্লাহ মিঠু দ¦ারিয়াপুর শরীফের গদ্দীনশীন পীর হিসেবে সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছেন।

এই পবিত্র ঈদ-ই-মীলাদুন্নবী (সাঃ)-এর মাসে তাঁর অগণিত ভক্ত অনুরাগী ও সুহৃদরা তাঁকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করছে এবং তাঁর অভাব প্রতিনিয়ত অনুভব করে। ওফাত বার্ষিকীর এই দিনে পাঠকরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও জান্নাতুল ফেরদৌসের সুউচ্চ মাকাম কামনা করছে। আমিন।

লেখক সাংবাদিক, গবেষক।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

এদেরসনকে হারানোর ধাক্কা সিটির, ব্রাজিলের জন্যও যা দুর্ভাবনার

এদেরসনকে হারানোর ধাক্কা সিটির, ব্রাজিলের জন্যও যা দুর্ভাবনার

জার্মানির ইউরো দলে ৪ গোলরক্ষক, নেই নাব্রি-হুমেলস

জার্মানির ইউরো দলে ৪ গোলরক্ষক, নেই নাব্রি-হুমেলস

আয়ে রোনালদো শীর্ষেই, পেছালেন মেসি

আয়ে রোনালদো শীর্ষেই, পেছালেন মেসি

ফের্মিন লোপেজের জোড়া গোলে জাভির শততম ম্যাচ জয়ে রাঙাল বার্সা

ফের্মিন লোপেজের জোড়া গোলে জাভির শততম ম্যাচ জয়ে রাঙাল বার্সা

১৫ কবি ও সাহিত্যিক পাচ্ছেন রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার

১৫ কবি ও সাহিত্যিক পাচ্ছেন রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার

ভূমিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন ভারতীয় হাইকমিশনার

ভূমিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন ভারতীয় হাইকমিশনার

হাতে চোট নিয়েও মেয়েকে নিয়ে কানে ঐশ্বরিয়া

হাতে চোট নিয়েও মেয়েকে নিয়ে কানে ঐশ্বরিয়া

ঢাকায় তিনদিনের কোল্ড চেইন ও অবকাঠামো প্রদর্শনী শুরু

ঢাকায় তিনদিনের কোল্ড চেইন ও অবকাঠামো প্রদর্শনী শুরু

ইট মারলে পাটকেল খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন

ইট মারলে পাটকেল খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন

মানুষের প্রতি শেখ হাসিনার আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বিরল : নাছিম

মানুষের প্রতি শেখ হাসিনার আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বিরল : নাছিম

দেশকে আরো এগিয়ে নিতে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

দেশকে আরো এগিয়ে নিতে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সোনালিকে ‘অপহরণ’ করতে চেয়েছিলেন শোয়েব আখতার!

সোনালিকে ‘অপহরণ’ করতে চেয়েছিলেন শোয়েব আখতার!

সরকারের লুটপাটে দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারায়: এমরান সালেহ প্রিন্স

সরকারের লুটপাটে দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারায়: এমরান সালেহ প্রিন্স

রাবিতে গাঁজা সেবনে বাঁধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে মারামারি

রাবিতে গাঁজা সেবনে বাঁধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে মারামারি

বাসে জাবি ছাত্রীকে যৌন হয়রানিতে জড়িতদের শাস্তির দাবি

বাসে জাবি ছাত্রীকে যৌন হয়রানিতে জড়িতদের শাস্তির দাবি

পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাড়ানোর সুপারিশ

পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাড়ানোর সুপারিশ

মসজিদে জামাত হওয়ার পর আবার জামাত করা প্রসঙ্গে।

মসজিদে জামাত হওয়ার পর আবার জামাত করা প্রসঙ্গে।

রাজধানীতে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা বন্ধে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ

রাজধানীতে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা বন্ধে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সংসদীয় কূটনীতি কার্যকর হাতিয়ার : স্পিকার

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সংসদীয় কূটনীতি কার্যকর হাতিয়ার : স্পিকার

সমাজে বিবাহকে সহজ করা দরকার

সমাজে বিবাহকে সহজ করা দরকার