ইসলামে নামের গুরুত্ব
০২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম
জন্মের পর প্রত্যেক পিতা-মাতাই চান তার সন্তানের সুন্দর নাম হোক, সবাই তার সন্তানকে ভাল নামে ডাকুক। এমনকি ব্যক্তি নিজেরও তার নাম সুন্দর হোক তা চান। একজন মুসলিমের সর্বোত্তম নাম কি হবে, কোন ধরনের নাম প্রশংসনীয়, কোন ধরনের নাম বৈধ বা অপছন্দনীয়, ইসলাম এ ব্যাপারে সুম্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের পর থেকে মুসলিমদের মধ্যে নামকরণের ইসলামী নীতি অনূসৃত হয়ে আসছে। মুসলিম সংস্কারক, আলিম-ওলামা এ ব্যাপারে মুসলিমদের সংস্কার করে আসছেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় মুসলিমদের মধ্যে যা অনুশীলিত হয়ে আসছিল, বর্তমানে ইসলামী রীতিনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতা, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব, আধুনিকতার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক বা অতি বাঙালী সাজার প্রবণতার কারণে অনেকাংশে এর অনুশীলনের ব্যাপারে শিথিলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ব্যক্তি বা বস্তুর পরিচয়ের ক্ষেত্রে নাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য যারা বলেন, নাম নয়; বৃক্ষ তার ফলে পরিচয়, তারাও কিন্তু নামহীন মানুষ নন। তাছাড়া ফল দেখার জন্য বৃক্ষের পাশে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করাও কঠিন। তাই আগে তার নাম জানা দরকার। নাম ছাড়া কোন ব্যক্তি বা বস্তুর পরিচয় দেয়া সম্ভব নয়। তাই মানব সমাজে সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর তার নাম রাখা একটি সর্বজনীন রীতি। এ পৃথিবীতে নামহীন একজন ব্যক্তিও পাওয়া যাবে না। ইসলামের নামের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তার নামের মাধ্যমেই সৃষ্টিজগতের নিজের পরিচয় দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্ সা. এর প্রতি নাযিলকৃত সর্বপ্রথম ওহীতেও তাঁর নামে পড়ার নির্দেশ রয়েছে।
অমুসলিম পন্ডিতগণও বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাহিত্যিক ও দার্শনিক ডরষষরধস ঐধুষরঃঃ বলেন, অ হধসব রং ধহপযড়ৎবফ রহ ঃযব ফববঢ় ধনুংং ড়ভ ঃরসব, ধং ষরশব ধ ংঃধৎ ঃরিহশষরহম রহ ঃযব ভরৎসধসবহঃ পড়ষফ, ফরংঃধহঃ, ংরষবহঃ, নঁঃ বঃবৎহধষ ধহফ ংঁনষরসব.
এভাবে শিশুসন্তান জন্মগ্রহণের পর তার নামকরণের ক্ষেত্রেও ইসলাম অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম সুস্পষ্টভাবে এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিধানাবলি প্রণয়ন করেছে। রাসূল স. নিজেই অনেক সাহাবীর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছেন। আবার কোন নাম রাখা যাবে, কিরুপ নাম রাখা যাবে না তা সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। এদেশের মুসলিমগণ ইসলামী নিয়মানুসারে নামকরণের এ বিষয়টি নিজেদের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে অনুসরণ করে আসছেন। কিন্তু বর্তমানে মুসলিমদের একটি অংশ অজ্ঞতাবশত অথবা বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে ইসলামী রীতি ভুলে বিভিন্ন বিকৃত পদ্ধতির অনুসরণে এ বিষয়টি নিজেদের মধ্যে চর্চা করছে। এ থেকে উত্তরণ প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। নামকরণ শব্দটি বাংলা। শব্দটি ‘নাম’ ধাতু থেকে উদ্ভুত। নাম বলতে বাংলায় আখ্যা, অভিধা, সংজ্ঞা, যে শব্দ দ্বারা কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে নির্ধারণ করা যায় ইত্যাদিকে বুঝায়। ইংরেজীতে শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে ঘধসব, ধঢ়ঢ়বষষধঃরড়হ, ঢ়বৎংড়হধষ হধসব, ঃরঃষব, ফবংরমহধঃরড়হ, রফবহঃরঃু ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়।
আরবীতে শব্দটির প্রতিশব্দ হচ্ছে ইসম। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- যা দ্বারা বস্তুকে চেনা যায় অথবা যা দ্বারা বস্তুর ব্যাপারে প্রমাণ পেশ করা হয়। অবশ্য আরবী ব্যাকরণে (নাহু শাস্ত্রে) এর ভিন্ন অর্থও রয়েছে।
আর নামকরণ বলতে অভিধানে রাখা, সন্তানের নাম রাখা, নবজাত শিশুর একাদশ বা দ্বাদশ দিনে নাম রাখার সংস্কার বিশেষ ইত্যাদি অর্থ করা হয়েছে।
বিষয়টি দ্বারা একাদশ দিনে নবজাতকের নাম রাখার অনুষ্ঠানের বুঝানো সম্ভবত হিন্দু ধর্মীয় একটি রীতি থেকে প্রচলিত হয়েছে। নামকরণ বলতে হিন্দুদের একটি ধর্মীয় সংস্কারকে বুঝায় অর্থাৎ হিন্দু ধর্মে নবজাতকের নামকরণের অনুষ্ঠান। জন্মের দিন অথবা জন্মের দশম, একাদশ বা দ্বাদশ দিনে পালিত হয়। দশম বা দ্বাদশ দিন হচ্ছে এ কাজের জন্য প্রশস্ত সময়। ইংরেজীতে এর প্রতিশব্দ ঘধসরহম, ঘধসব মরারহম, ঘড়সবহপষধঃঁৎব ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। আর আরবীতে তাসমিয়া এর প্রতিশব্দ। এর অর্থ নবজাতক বা কোন বস্তুর চিহ্নসূচক নামকরণ করা। যেমন আরবীতে বলা হয় ‘ছাম্মাহু কুন্না’ অর্থাৎ সে তার এরূপ নামকরণ করল। এর সাথে সংশ্লিষ্ট শব্দ তাকনিয়াহ্- উপনাম নির্ধারণ, তালক্বীব- উপাধি প্রদান ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়। আর নবজাতক বলতে সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া সন্তান বা সদ্যজাত শিশুকে (ঘবনিড়ৎহ নধনু) বুঝায়। অতএব নবজাতকের নামকরণ বলতে সদ্যজাত শিশুর নাম রাখাকে বুঝায়।
ইসলাম ব্যক্তির নামকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। যথার্থ নামকরণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির পরিচয় তুলে ধরার ব্যাপারে ইসলামের দিক নির্দেশনা সুস্পষ্ট।
মহান আল্লাহ তাঁর নিজের পরিচয় দেয়ার জন্য নিজেকে নিজেই নামকরণ করেছেন। তিনি তাঁর অসংখ্য নাম রেখেছেন। আমরা উম্মতে মুহাম্মাদীর নিকট তাঁর নিরানব্বইটি নাম প্রকাশ করা হয়েছে। রাসূল স. তাঁর একটি দু‘আয় এভাবে উল্লেখ করেছেনে যে, ‘হে আল্লাহ... আমি তোমার সকল নামের উসিলায় তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, যে নামে তুমি তোমাকে নামকরণ করেছ...’।
আল্লাহ্র নাম গুণাবলির একত্বের প্রতি ঈমান আনা প্রত্যেক মুমিনের জন্য আবশ্যক। আল্লাহ্র একত্বকে আক্বীদার কিতাবসমূহে সাধারণত ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর অন্যতম ভাগ হচ্ছে ‘তাওহীদুল আস্মা ওয়াস্ সিফাত’ অর্থাৎ আল্লাহর নাম ও গুণাবলির একত্ব। তাঁর নামসমূহে কোন প্রকার বিকৃতি, তুলনা, সাদৃশ্য, হ্রাসবৃদ্ধি করা সম্পূর্ণরূপে ঈমানের পরিপন্থী। মহান আল্লাহ্ বলেন, এবং আল্লাহর আছে সুন্দরতম নামসমূহ। তোমরা এ নামসমূহ দ্বারা তাকে ডাকবে। যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করবে। তাদের কৃতকর্মের ফল শ্রীঘই তাদেরকে প্রদান করা হবে।
আল্লাহর নামসমূহের উসিলা করে তাঁর কাছে প্রার্থনা করা এবং তাঁর নামসমূহের মাধ্যমে তাঁকে ডাকার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, বলুন, আল্লাহ বলে ডাক কিংবা রহমান বলে, যে নামেই ডাকনা কেন, সব সুন্দর নাম তাঁরই। ঈসা আ. এর মধ্যমে পূর্ববতী জাতির নিকট মুহাম্মাদ স. এর আগমনের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, আর স্মরণ কর, যখন মরিয়ম তনয় ঈসা আ. বলল, হে বনী ইসরাঈল- আমি তোমাদের নিকট থাকা তাওরাতের সত্যায়নকারী, তোমাদের প্রতি প্রেরিত আল্লাহ্র একজন রাসূল এবং এমন একজন রাসূলের সুসংবাদ দাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন তাঁর নাম আহমদ। আল্লাহ কিছু ক্ষেত্রে তাঁর প্রিয় বান্দাদের নিজেই নামকরণ করে দিয়েছেন। এটি আল্লাহ্র পছন্দনীয় নাম। যেমন ইয়াহ্ইয়া আ. এর ব্যাপারে আল্লাহ্ বলেন, হে যাকারিয়া, আমি তোমাকে এক পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম হবে ইয়াহ্ইয়া। ইতঃপূর্বে এ নামে আমি কারো নামকরণ করিনি।
মহান আল্লাহ আদম আ. কে সৃষ্টি করে তাকে সৃষ্টি জগতের সবকিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন। নাম শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি জগৎ সম্পর্কে তাকে জ্ঞাত করান এবং যার মাধ্যমে ফিরিশতাকূলের উপর তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মহান আল্লাহ বলেন, আর তিনি (আল্লাহ) আদমকে সকলবস্তু সামগ্রীর নাম শিক্ষা দিলেন।
একটি বস্তু বা একজন ব্যক্তির পরিচয় তার নামের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ব্যক্তির নাম, গোত্র, বংশ ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজে ব্যক্তি স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে টিকে থাকে। অন্যথায় ব্যক্তি সমাজের সাথে একাকার হয়ে যেত। তাকে নির্দিষ্ট করে পরিচিত করার কোন উপায় থাকত না। মহান আল্লাহ্ বলেন, হে বিশ্বমানব, আমি তোমাদেরকে নারী-পুরুষে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন দল-গোত্রে বিভাজিত করেছি, যাতে তোমরা পর¯পর পরিচিত হতে পার। ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পরিচয় সে নামেই হবে যে নামে তাকে পৃথিবীতে ডাকা হত। যদি ভাল নাম হয় তাহলে ভাল নামে, অন্যথায় তার খারাপ নামে তাকে ডাকা হবে। (চলবে)
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারতে -দুলু
বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন
২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের
ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা
চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত
এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে
ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী
আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ
বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত
মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক
ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন
কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু
আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ
ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী
সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু
যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের
পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন
শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি স্থবির খুলনা শহুরে জীবন