ইসলামের দৃষ্টিতে ঘুষ-দুর্নীতি
৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১২ এএম | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১২ এএম
ইসলাম হালাল উপার্জনের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। একজন মুসলমানের অর্জিত সম্পদ যেন হালাল হয়, হারাম যেন না হয়, আমরা পবিত্র কোরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ থেকে সে শিক্ষাই পেয়ে থাকি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন- ‘হে মানব সকল! জমিনের মধ্যে যা হালাল ও পবিত্র তা থেকে ভক্ষণ করো।’ (আল-বাকারা-১৬৮)। ঘুষের প্রতি নিন্দা এবং তা আদান- প্রদাণকারীর ওপর রাসুল (সা:) অভিসম্মাত করেছেন। হাদীসে এসেছে- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) বর্ণনা করেন, রাসুল (স:) ঘুষদাত এবং গ্রহীতার উপর অভিসম্মাত করেছেন। (মুসনাদে আহমদ)। রাসুল (সা:) আরো বলেন, ঘুষ আদান- প্রদানকারী উভয়ে জাহান্নামে যাবে। (তাবরানি)।
এ কথা সর্বজন বিদিত যে, ঘুষ-দুর্নীতি বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা। ইহা আমাদের জাতীয় উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে প্রধান অন্তরায়। যে কোন জাতির নৈতিক মূল্যবোধ লালন-পালন ও এর বিকাশ সাধন খুবই জরুরী। কেননা মানব জাতির ইহকালীন উন্নতি ও পরকালীন মুক্তি বহুলাংশে এর উপর নির্ভরশীল। আর নৈতিক মূল্যবোধ অর্জনের নির্ভরযোগ্য বুনিয়াদ হচ্ছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি অগাধ বিশ^াস স্থাপন এবং তারই নবী- রাসূলগণ আনীত পথে অনুসরণ ও অনুশীলন। নি:সন্দেহে এ বিশ^াসই আমাদেরকে আলোকিত পথের সন্ধান দেবে এবং আমাদের অন্তরে বপন করবে ঈমানদারী আমানদকারী পরস্পরের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা, মানবতাবোধ, ত্যাগ-তিতীক্ষা, সততা-সহমর্মিতা, সত্যানুরাগীতা ও সত্যবাদিতা ইত্যাদির বীজ যা পত্র পল্লবে, ফুলে ফলে শতগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে আমাদেরকে করবে প্রকৃত মানুষ, সৃষ্টির সেরাজীব-আশরাফুল মাখলুকাত! কিন্তু অত্যান্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আজ নৈতিক মূল্যবোধের ধস নেমেছে। অন্ধবস্তবাদী ধ্যান ধারণা মানুষের জীবনকে খাবার টেবিল ও টয়লেটের মধ্যে সীমাবন্ধ করে রেখেছে। অর্থাৎ খেতে হবে খাবার টেবিলে যাও। আর পেট খালি করতে হবে টয়লেটে যাও। যত চেষ্টা-প্রচেষ্টা, সংগ্রাম, সংঘাত, যুদ্ধ-দ্বন্দ, অর্জন-অর্পণ, শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বানিজ্য, অনুশলীন- অনুবিক্ষণ, পেশা-নেশা, ক্ষেপনাস্ত্র-মরনাস্ত্র, আমবিক- পারমানবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র সবকিছু এ জন্যেই পরিচালিত। এ বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণা প্রথম ও শেষ কথা হলো- সম্পদ অর্জন করতে হবে, আর তা যে করেই হোক। এক সময় ছিলো যখন মানুষ খারাপ কাজ করতে কিছুটা হলেও সংকোচবোধ করতো। যারা ঘুষ খেতো তারা টেবিলের নিচ দিয়ে হাত পাততো। কিংবা পিয়ন চৌকিদারের মাধ্যমে তা গ্রহণ করতো। কিন্তু আজ আর সে সংকোচ বোধের বালাই নেই। এখন ঘুষ খোরেরা বিব্রত হয় না। বরং ঘুষদাতা ঘুষখোরদের বীরদর্পে ঘুষ খাওয়া দেখে বিব্রত হয়। এ সব ঘুষ খোরদের এও বলতে শোনা গেছে আমরা কাজ করে পয়সা নেই। কাজ না করে নেই না। অতএব সংকোচ কিসের। কোথাও কোথাও এমনও দেখো গেছে জমিজামা সংক্রান্ত জরিপ আপত্তি-নিস্পত্তি করার জন্য বড় কর্মকর্তা লালসালু টেবিলের চুতুর্দিকে লাগিয়ে বসেছেন। লাল কাপড় টাঙ্গানোর মাহাত্ব হচ্ছে, এখানে মার-দাঙ্গা তর্ক-বিতর্ক,বাক-বিতন্ডা নিষিদ্ধ। এ লাল কাপড়ের মর্যাদা বড় কর্তা কত দূর বসছেন? তিনি প্রকাশ্যে দিবা-লোকে প্রশ্ন রাখছেন, আপনার প্রস্তুত হয়ে এসেছেন তো? বাদী-বিবাদী বললেন, জি হ্যাঁ। তখন তিনি বিষয়টি ফায়সালা করলেন এবং সকলের সম্মুখে লাল কাপড়ে ঘেরা টেবিলে ঘুষ! নামক বস্তু গ্রহণ করে জরিপ আপত্তি-নিষ্পত্তি করলেন।
ইতোমধ্যে পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ পৃথিবীর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সমূহের তালিকায় র্শীষে অবস্থান করছে। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে দেশের জিডিপির শতকরা প্রায় দুই অংশ ঘুষ দুর্নীতি সংহার করে ফেলে। ঘুষের প্রচলন যদি না থাকতো এবং দুর্নীতি যদি না থাকতো, তাহলে আমাদেরকে বিদেশের নিকট সাহায্যের জন্য হাত পাততে হতো না। বিশ^ব্যাংক কিংবা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবীলের কঠিন ও অপমানজনক শর্তগুলো মেনে নিতে হতো না। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে আমাদের দেশের গরিব নিরীহ জনগণ থেকে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে যারা রক্ত চোষা জোঁকের মত অর্থ-সম্পদ চুষে নিচ্ছে, তারা কিন্তু নিরক্ষর নয়। তারা স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা ও বিশ^বিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ধারী সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণী! এও লক্ষণীয় বিষয় যে, যার টেবিলের মাপ যত বেশি তাকে ঘিরে ঘুষের রমরমা ব্যবসা অতি জমজমাট। এর যেন কোন শেষ নেই! যেখানে কোন সই-স্বাক্ষর আছে, সেখানে ঘুষ আছে। আরো লজ্জার বিষয় এই যে, যারা ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবেন, আমাদের ভবিষৎ বংশধরদের হাতে কাগজ-কলম তুলে দিবেন, সেই মানুষ গড়ার কারিগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দকেও ঘুষ দিয়ে শিক্ষকতার পেশায় আসতে হয়। এর চেয়ে জঘন্যতম অপরাধ আর কী হতে পারে? তারা কিইবা শিক্ষা দেবেন এবং তাদের থেকে জাতি সততা ও দেশ প্রেমের আশা কত দূরই করতে পারেন?
একজন মুসলমান হিসেবে এবং একজন সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং কার্যকর ভাবে এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসা আমাদের সকলেরই কর্তব্য। আর যদি আমরা তা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা এবং আমাদের ভবিষৎ প্রজন্ম দুর্নীতির প্রচন্ড সয়লাবে আকন্ট নিমজ্জিত হয়ে ইতহাসের আস্তা কুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এমনকি দুর্নীতির আশঙ্কাজনক ব্যাপকতা ও আধিক্যের কারণে আমাদের স্বকীয়তা ও জাতীয় স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখিন হতে পারে। অবশ্য সমস্যাটি এতো প্রকট ও ব্যাপক যে, স্বল্প সময়ে নিরসন করা খুবই দুরুহ ব্যাপার। তবে কথা হচ্ছে, প্রথমে সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। আজ আমাদের অনুভূতি ও অনুধাবনেও ঘুণে পোকা আস্তানা গেড়েছে। এ অবস্থায় তো চলতে দেয়া যায় না। অবশ্য কাউকে না কাউকে এ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্যান্সার নির্মূলে এগিয়ে আসতে হবে। অন্তত শুরুটা তো হতে হবে! আর এ উদ্দেশ্যেই আমার ছোট্র এ লেখাটি।
প্রথমে আলোচনার প্রয়াস পাব ঘুষ কাকে বলে? ঘুষের আরবী শব্দ হচ্ছে রিসওয়াত যা ‘রিসাউন’ বা রিসা শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। রিসা ঐ রশিকে বলে। যা দ্বারা (বালতি বেধে) কূপ থেকে পানি উত্তোলন করা হয়। ঘুষ দ্বারা ঠিক এ কাজ করা হয়। দূরের বস্তুকে কাছে নেয়া হয় এবং এর মাধ্যমেই ঘুষদাতা স্বীয় উদ্দেশ্য সাধন করে। ফিকহ শাস্ত্রবিদ ও মনীষিগণ ঘুষ এবং ঘুষ সম্পর্কিত বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন।
০১। রিসওয়াত ঐ বস্তু যা কোন ব্যক্তি নিজের পক্ষে কোন কিছুর করার উদ্দেশ্যে কোন কর্মকর্তা কিংবা অন্য কাউকে প্রদান করে। আল-একলীল আলা মাদারেকিত তানজীল !
০২। আল্লামা ইউসুফ কারদাঙ্গী তাঁর সুবিখ্যাত আল হালাল ওয়াল হারাম গ্রন্থে বলেন- ‘ঘুষ’ ঐ বস্তু যা কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তি অথবা অন্য কোন সাধারণ কর্মচারীকে দেয়া হয়ে থাকে যাতে করে তিনি ঘুষ দাতার পক্ষে হুকুম জারি করেন অথবা তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তার ইচ্ছানুযায়ী রায় প্রদান করেন।
০৩। আল্লামা সৈয়দ সোলায়মান নদভী মাজমাউল বেহাল কেতাবের উদ্ধৃতি লিখেছেন: রিসওয়াতের অর্থ কোন ব্যক্তি কর্তৃক স্বীয় অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য কিংবা অন্যায় দাবি আদায়ের নিমিত্তে অন্য কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা কর্মচারীকে কিছু প্রদান করে তাকে নিজ মতের অনুসারী করানো। (সীরাতুনবী, খন্ড-৬ পৃঃ৭০১)। (চলবে)
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার
সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার
যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২
ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল
সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ
গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন
যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার
৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান
তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা
শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত
গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক
কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়
ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম
যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ
মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা
মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী