আধ্যাত্ম জগতের সূর্যপ্রভা শাহ্সূফি আহসানুল্লাহ রহ.

Daily Inqilab মুহাম্মদ কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী

৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১২ এএম | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:১২ এএম

আধ্যাত্ম জগতের নব আকাশের দীপ্তমান সূর্য সূফি মাওলানা হজরত কেবলা শাহ্ আহসানুল্লাহ রহ. আঠার শতকের একজন সুপ্রসিদ্ধ ধর্মপ্রচারক ও সমাজসংস্কারক। ইসলামের অপব্যাখাকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। এ মহান গুণীজনের মাজার শরীফ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শাহ্ সাহেব বাড়ী নারিন্দা মশুরীখোলা দরবারে অবস্থিত। তাঁর প্রসিদ্ধ নাম হচ্ছে হজরত কেবলা ও দরবেশ মিয়া।

বাংলার জনপদের এ মহান সাধক পুরুষ ২৫ ই জুলাই ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা শাহ্ নূর মুহাম্মদ রহ.’র ঘরে আড়াইহাজার থানার টেটিয়া নামক একটি ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বি.’র বংশধর বিশিষ্ট ধর্মপ্রচারক হজরত নাওজাওয়ান রহ.। যিনি হজরত শাহ্ জালাল ইয়েমেনীর সহযোদ্ধা বাবা আদম শহীদ রহ.’র অন্তরঙ্গ বন্ধু। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি সুদূর আরব হতে ভারত হয়ে এ বঙ্গদেশে আগমন করেন। হজরত কেবলা ছিলেন এ বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্রতূল্য আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ। শৈশবেই হজরত কেবলার পিতা-মাতা পরলোক গমন করেন। পিতা-মাতা, পিতামহী ও মামার কাছ থেকে কুরআনুল করীমের বিশুদ্ধ পাঠসহ আরবি, উর্দ্দু, বাংলা ও ফারসি ভাষার বুৎপত্তিগত জ্ঞান, গণিত শাস্ত্র ও নবী-রাসূলদের জীবন-কাহিনী ও সদুপদেশ মূলক জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর মামা ছিলেন ঢাকা আজিমপুর দায়রা শরীফের সাজ্জাদানশীন শাহ্্ সূফি সৈয়দ লাকিত উল্লাহ রহ.’র সন্তান হজরত শাহ্ সূফি সৈয়দ হাফিজুল্লাহ রহ.’র শিক্ষক। ইলমে তফসির (তফসিরে বায়জাবী, তফসিরে ইবনে আব্বাস, তফসিরে জরীর/তাবারী) ও ইলমে হাদিসের (সিহাহ সিত্তাহ ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থ) জ্ঞান লাভ করেন সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার সুজাতপুর ইউনিয়নের মাওলানা নেজামুদ্দীন রহ.’র কাছ থেকে। তাঁর হাতের লেখা ছাপানো অক্ষরের মত সুন্দর ছিলো। বহু তফসির ও হাদিস গ্রন্থ স্ব-হস্তে লিখেছেন। ইলমে শরীয়তের সমস্ত শাখা-প্রশাখার জ্ঞানার্জন শেষে করে; ইলমে তাসাউফের জ্ঞান অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করেন। এ হালত! নানাজান শাহ্ পীর মুহাম্মদ রহ.’র দৃষ্টিগোচর হলে তাঁকে তরীক্বতের প্রাথমিক ধাপের জ্ঞান এবং লা-ইলাহা ইল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র ছবক সহ জিকির-আজকার ও দোয়া-দরুদের শিক্ষা দেন। তাঁর আত্মিক উন্নতি সাধিত হলে নানাজান তাঁকে পশ্চিম দেশে সফরের নির্দেশ দেন। যথাসময়ে আরব দেশে সফর করেন এবং হজ¦ব্রত পালন করে ইরাক ও খোরাসান হয়ে বঙ্গদেশে ফিরে আসেন। এ সফরে আরব, ইরাক ও খোরাসানের বহু বুজুর্গানে দ্বীনের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং অনেক আল্লাহর অলীদের মাজার জেয়ারত করেন। এ সফরটি ছিলো তাঁর জীবনের একটি ঐতিহাসিক সফর। এ সফরের মাধ্যমে আধ্যাত্ম জগতের নতুন নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হয়েছিল তাঁর। একদা এক মজ্জুব ফকির তাঁর বাড়ীতে আগমন করেন। আতিথেয়তা গ্রহণ পূর্বক মজ্জুব ফকির বলেছিলেন ‘‘বাবা! থোরা রোজ কী আন্দর এক হজরত আয়েঙ্গে, উয়ে তোমকু এলমে আসরার কী তা’লীম দেয়েঙ্গে। একদা হযরত কালীম শাহ্ বাগদাদী রহ. নামে এক আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষ সুদূর ইরাক হতে বড়পীর আবদুল আবদুল কাদের জিলানী রহ’র নির্দেশক্রমে এ বঙ্গদেশে তথা হজরত কেবলার ঢাকার সাভার বাড়ীতে তাশরিফ আনেন এবং তাঁকে ইলমে আসরারের (আল্লাহ পাকের রহস্যময় জ্ঞান) শিক্ষাদান পূর্বক ক্বাদেরিয়া তরীক্বার বায়’আত ও খেলাফত বখশিশ করেন। বাগদাদী সাহেব রহ. কবিরাজী ও হেকিমী চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। এ সুবাদে তাঁকে রূহানী শিক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসা বিদ্যায়ও পারদর্শী করে তুলেন। বাগদাদী সাহেব প্রায় এক বছর হজরতের ঢাকার সাভার বাড়ীতে অবস্থান করেন। বাগদাদী সাহেব রহ. স্বদেশ ইরাকে চলে যাওয়ার সময় তাঁকে দোয়া ও নসিহত পূর্বক বলেছিলেন, ‘‘বাবা! আপনি চিশতিয়া তরীক্বার মুরিদ হতে পারলে বেলায়াতে কুবরার মাকামে পৌঁছতে পারবেন’’। তাঁর চিশতিয়া তরীক্বার পীর হলেন আমিরুল মু’মিনীন হজরত সৈয়দ আহমদ শহীদ রায়বেরেলী রহ’র প্রখ্যাত খলিফা হজরত খাজা গোলজার শাহ্ রহ.’র স্নেহধন্য শিষ্য খাজা লশকর মোল্লা রহ.। তাঁর মাজার নরসিংদীর জেলার সদর থানার পাইকার চর ইউনিয়নের দড়িচর ভাসানিয়া গ্রামে। হজরত কেবলা ক্বাদেরীয়া ও চিশতীয়া তরীক্বায় মুুরিদানদের ইলমে তাসাউফের তালিম দিতেন। সুদীর্ঘ ১৮ বছর অর্ধহারে-অনাহারে কয়েকটি জায়গায় সাধনাজীবন অতিবাহিত করেন। তন্মধ্যে- বিশিষ্ট ধর্মপ্রচারক মাওলানা শাহ্ আলী বাগদাদী রহ.’র মাজার শরীফে ১৪ বছর (মিরপুর- ০১, ঢাকা), নারায়ণগঞ্জ শাহী কিল্লাহ সংলগ্ন পাকা কবরের পাশে^ প্রায় ৩ বছর এবং ঢাকা লালবাগ শাহী মসজিদ সংলগ্ন মসজিদ সুরঙ্গেঁ ১ বছর। কঠোর রেয়াজতের মধ্যদিয়ে তিনি আল্লাহর চূড়ান্ত রেজামন্দি হাসিল পূর্বক ইলমে বেলায়াত লাভ করেন। এরপর নানাজানের নির্দেশক্রমে সুন্নাতে নববী তথা চাচাতো বোনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু বিবাহের প্রথম রাতেই নব-বিবাহিত পত্নী কলোরায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। দ্বিতীয় বিবাহ সমাধা করেন মশুরীখোলার কাজী মঈনুদ্দীন মোল্লার মেয়ের সাথে। এ ঘরে ৯ কন্যা ও ৪ পুত্র সন্তান। তৃতীয় বিবাহ সমাধা করেন খাজা শাহ্ লশকর মোল্লা রহ.’র তালাকপ্রাপ্ত মেয়ের সাথে।

সতোর শতকে এ উপমহাদেশের ধর্মীয় অবস্থা আইয়ামে জাহেলিয়ার মতই ছিলো। এ কঠিন সময়ে জান-প্রাণ বাজি রেখে ইসলামের অপব্যাখ্যাকারীদের বিরুদ্ধে কালামে-কলমে, ওয়াজে-বয়ানে ও নসিহতে সংগ্রাম শুরু করেন। যার ফলে সত্য অনুসন্ধানী আল্লাহ ওয়ালা ও নবী প্রেমিকগণ দলে দলে তাঁর যুগপৎ আন্দোলনে ও জাগরণে একাত্মতা পোষণ করেন। এ সময়ে আল্লাহর দ্বীনকে পুনরায় এ জমীনে প্রতিষ্ঠার জন্য আওলাদে রাসূল, শহীদে বালাকোট, মুহাম্মাদীয়া তরীক্বার প্রবর্তক, সৈয়দ আহমদ শহীদ রায়বেরেলী রহ.’র অসংখ্য অনুরাগী বাংলার প্রতিটি জনপদে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন। তন্মধ্যে, মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী, সূফি নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী, মাওলানা খাজা শাহ্ গোলজার ও হজরত মাওলানা ইমামুদ্দীন সন্দীপিসহ অসংখ্য দাঈয়ী। যাঁরা বালাকুটি নামে মশগুর। এ সুবাধে মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরী রহ. ও মাওলানা কাজী ইমামুদ্দীন সন্দীপি রহ.’র সান্নিধ্য পান। বেশ কিছু দিন তাঁেদর সোহবতে থেকে দ্বীন প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। (চলবে)

লেখক: সূফিবাদী লেখক ও গবেষক।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রোহিঙ্গাসংকট: সমাধানের পথ খুলুক দ্রুত
মাইজভা-ার শরিফ : ঐশ প্রেক্ষিত
রমজানে খাদ্য গ্রহণে সচেতন হোন
রমজানের রহমত-মাগফিরাত-নাজাতের বানে ভেসে যাক পাপ
আল্লাহ ছাড়া কোন আশ্রয়স্থল নাই
আরও
X

আরও পড়ুন

মতলব মুন্সীর হাট বাজারে আগুনে পুড়েছে ১৭ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

মতলব মুন্সীর হাট বাজারে আগুনে পুড়েছে ১৭ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

আর্টেমিস অ্যাকর্ডে যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশকে স্বাগত জানাল যুক্তরাষ্ট্র

আর্টেমিস অ্যাকর্ডে যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশকে স্বাগত জানাল যুক্তরাষ্ট্র

দেশের চার অঞ্চলে দুপুরের মধ্যেই ঝড়ের শঙ্কা, নদীবন্দরগুলোকে সতর্ক বার্তা

দেশের চার অঞ্চলে দুপুরের মধ্যেই ঝড়ের শঙ্কা, নদীবন্দরগুলোকে সতর্ক বার্তা

সাগরে ডাকাতি: ২ কোটি টাকার মালপত্র লুট, ২৫ ঘণ্টা পর ৬৮ জেলে উদ্ধার

সাগরে ডাকাতি: ২ কোটি টাকার মালপত্র লুট, ২৫ ঘণ্টা পর ৬৮ জেলে উদ্ধার

ইসরাইলি অবরোধে অপুষ্টিতে ভুগছে গাজার ৬০,০০০ শিশু : জাতিসংঘ

ইসরাইলি অবরোধে অপুষ্টিতে ভুগছে গাজার ৬০,০০০ শিশু : জাতিসংঘ

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গোপন ঢাকামুখী যাত্রা, গোয়েন্দা তথ্যে চাঞ্চল্য

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গোপন ঢাকামুখী যাত্রা, গোয়েন্দা তথ্যে চাঞ্চল্য

ঢাকায় তাপমাত্রা কমার আভাস, শীতল দিনে স্বস্তির সম্ভাবনা

ঢাকায় তাপমাত্রা কমার আভাস, শীতল দিনে স্বস্তির সম্ভাবনা

হঠাৎ বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, ভারতের উদ্দেশ্য কী ছিল?

হঠাৎ বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, ভারতের উদ্দেশ্য কী ছিল?

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৯ জিএমকে ডিএমডি পদে পদোন্নতি

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৯ জিএমকে ডিএমডি পদে পদোন্নতি

নোয়াখালীতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের দাবিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি ডিসি'র

নোয়াখালীতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের দাবিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি ডিসি'র

ইসরায়েলের বর্বরতার প্রতিবাদে রাজধানীতে মোটরসাইকেল র‌্যালি

ইসরায়েলের বর্বরতার প্রতিবাদে রাজধানীতে মোটরসাইকেল র‌্যালি

সৈয়দপুরে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতার বাড়ি থেকে বোমা সাদৃশ্য বস্তু উদ্ধার

সৈয়দপুরে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতার বাড়ি থেকে বোমা সাদৃশ্য বস্তু উদ্ধার

বিনিয়োগকারীদের চোখ আগামী নির্বাচিত সরকারের দিকে: খসরু

বিনিয়োগকারীদের চোখ আগামী নির্বাচিত সরকারের দিকে: খসরু

ভারতজুড়ে ওয়াকফ আইন নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ ও আইনি লড়াই

ভারতজুড়ে ওয়াকফ আইন নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ ও আইনি লড়াই

ভক্ত, দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখোরিত মোরেলগঞ্জের লক্ষীখালি বারুনী স্নানোৎসব ও ধর্মীয় মাতুয়া মেলা

ভক্ত, দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখোরিত মোরেলগঞ্জের লক্ষীখালি বারুনী স্নানোৎসব ও ধর্মীয় মাতুয়া মেলা

ইসরায়েলি অবরোধে ত্রাণহীন গাজায় মানবিক বিপর্যয়

ইসরায়েলি অবরোধে ত্রাণহীন গাজায় মানবিক বিপর্যয়

ড. ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আনবে, প্রত্যাশা আমিরাত প্রেসিডেন্টের

ড. ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আনবে, প্রত্যাশা আমিরাত প্রেসিডেন্টের

নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ গেল দুই বোনের

নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ গেল দুই বোনের

জীবিত অভিবাসীদের ‘মৃত’ ঘোষণা করে তাড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন

জীবিত অভিবাসীদের ‘মৃত’ ঘোষণা করে তাড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন

বঙ্গোপসাগরে ৪ ট্রলারে ডাকাতি, গুলিবিদ্ধসহ আহত ৮

বঙ্গোপসাগরে ৪ ট্রলারে ডাকাতি, গুলিবিদ্ধসহ আহত ৮