ঢাকা   মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২ আশ্বিন ১৪৩১

জাহান্নামের ভয়ানক আযাব থেকে পরিত্রাণের অনন্য মাধ্যম

Daily Inqilab মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম

১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম

মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: নিশ্চয় আমি জালিমদের জন্য ঐ আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি, যার দেয়ালগুলো তাদেরকে পরিবেষ্টন করে নেবে এবং যদি সে পানির জন্য ফরিয়াদ করে তবে তার ফরিয়াদ ঐ পানি দ্বারা পূর্ণ করা হবে, যা গলিত ধাতুর ন্যায় হবে, যা তার মুখমন্ডলকে ভুনে ফেলবে। কতই নিকৃষ্ট পানীয় এবং দোযখ কতই নিকৃষ্ট অবস্থানের জায়গা! অত্র আয়াত থেকে অনুধাবন করা যায় যে, জাহান্নামীদের অবস্থা কতই না শোচনীয় হবে এবং জাহান্নামে তাদের কিরূপ কঠিন আযাবের সম্মুখীন হতে হবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে শেখানোর জন্য অধিকহারে জাহান্নামের আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন।মনে রাখবেন! দুনিয়ার আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর (৭০) ভাগের একভাগ। (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং- ২৮৪৩) জাহান্নামের আগুন এক হাজার (১০০০) বছর পর্যন্ত প্রজ্জলিত করা হলো, এক পর্যায়ে তা লাল হয়ে গেলো, অতঃপর আরো এক হাজার (১০০০) বছর, এক পর্যায়ে তা সাদা হয়ে গেলো, অতঃপর আরো এক হাজার (১০০০) বছর প্রজ্জলিত করা হলো, অবশেষে তা কালো হয়ে গেলো, এখন তা একেবারে কালো। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং- ২৬০০)

হযরত সায়্যিদুনা জিব্রাঈল আমীন আলাইহিস সালাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট শপথ করে আরয করেন: যদি জাহান্নামকে সুইয়ের ডগা পরিমান খুলে দেয়া হয়, তবে সকল পৃথিবীবাসী এর গরমে মারা যাবে এবং শপথ করে বললেন: যদি জাহান্নামের কোন দারোগা (নিরাপত্তারক্ষী) পৃথিবীবাসীর সামনে প্রকাশ হয় তবে পৃথিবীতে অবস্থানকারী সবাই তাঁর ভয়ে মারা যাবে। আর শপথমূলক বর্ণনা হলো: যদি জাহান্নামীদের শিখলের একটি কড়া দুনিয়ার পাহাড়ের উপর রাখা হয় তবে কাঁপতে শুরু করবে এবং তা স্থির হবে না, এক পর্যায়ে নিচের মাটি পর্যন্ত ধ্বসে যাবে। (মজমুয়ায যাওয়ায়িদ, হাদীস-১৮৫৭৩)

যার সবচেয়ে কম আযাব হবে, তাকে আগুনের জুতা পরিধান করানো হবে, যার কারণে তার মগজ এমনভাবে ফুটতে থাকবে, যেমন তামার পাতিল ফুটতে থাকে, সে মনে করবে যে, সবচেয়ে বেশি আযাব তাকেই দেয়া হচ্ছে, অথচ তার উপর সবচেয়ে হালকা আযাব হচ্ছে। (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং-৩৬৪) দুনিয়াবী আগুন সহ্য করার কারো ক্ষমতা নাই তবে জাহান্নামের আগুন কিভাবে সহ্য হবে? শুধু তাই নয় বরং আগুন ছাড়াও আরো অনেক ভয়ঙ্কর আযাব হবে। সুতরাং নিরাপত্তা এতেই যে, জাহান্নামের ভয়াবহতা, পুলসিরাতের বিপদ এবং আখিরাতে আসা জ্ঞান লোপ পাওয়া অবস্থার প্রতি দৃষ্টি রেখে তা থেকে বাঁচার চেষ্টা করা। হযরত সায়্যিদুনা ইমাম গাযালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: যে ব্যক্তি দুনিয়ায় থাকাবস্থায় কিয়ামত সম্পর্কে বেশি চিন্তা ভাবনা করবে, সে সেই ভয়াবহতা থেকে বেশি নিরাপদ থাকবে। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি দু’টি ভয় একত্র করেননা। সুতরাং যে দুনিয়ায় এই ভয়াবহতার প্রতি ভীত থাকে, সে আখিরাতে তা থেকে নিরাপদ থাকবে এবং ভয় দ্বারা মহিলাদের ন্যায় কান্নাকাটি করা নয় যে, চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত করবে এবং সেমার সময় অন্তর ন¤্র হয়ে যায়, অতঃপর তোমরা তা ভূলে নিজেদের খেলাধূলায় লিপ্ত হয়ে যাও। এই অবস্থা ভয়ের সাথে সম্পর্কীত নয়, বরং যে ব্যক্তি যে জিনিসকে ভয় করে, তা তাড়াতে থাকে এবং যে জিনিসের আশা রাখে তা চায়। সুতরাং তোমাদের ঐ ভয়ই মুক্তি দিবে, যা আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যতা থেকে বিরত রাখে এবং তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের প্রতি ধাবিত করে। (ইহইয়াউল উলুম, ৫/২৮৬-২৮৭)

যদি আমরা জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচতে চাই এবং জান্নাতের স্থায়ী নেয়ামতের হকদার হওয়ার আকাক্সক্ষী হই, তবে আমাদের সকল প্রকার গুনাহ যেমন; নামায ছেড়ে দেয়া, দাঁড়ি মুন্ডন করা বা এক মুষ্টি থেকে ছোট করা, পিতা-মাতাকে কষ্ট দেয়া, মহিলাদের বেপর্দা বাজারে ঘুরাফেরা করা, সিনেমা-নাটক দেখা এবং দেখানো, গান বাজনা শুনা বা বাজানো, হারাম উপার্জন করা, সূদী ব্যবসায় শরীক হওয়া, খারাপ গালি-গালাজ, গীবত, চুগলী এবং দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করা এবং বে নামাযী ও ফ্যাশন পুজারী মন্দ বন্ধুদের সাথে উঠবসা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখবেন! গুনাহ থেকে বাঁচার উত্তম উপায় এটাও যে, আমরা কিয়ামতের দিন গুনাহের কারণে অপমানিত ও অপদস্ততা হওয়ার প্রতি সজাগ থেকে আল্লাহ তায়ালার ভয়ও নিজের অন্তরে গেঁথে নিবো। কেননা, খোদাভীতি এমনই এক ঔষধ, যা দ্বারা গুনাহের রোগের চিকিৎসা সম্ভব। যতক্ষন পর্যন্ত এই মহান নেয়ামত অর্জিত হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত গুনাহের প্রতি ঘৃণা এবং নেকীর প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। আসুন! অন্তরে খোদাভীতির প্রদীপ জ্বালাতে খোদাভীতিতে কান্না করার ফযীলত সম্পর্কীত তিনটি হাদীস শরীফ শ্রবন করি: ১. দুটি চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না: একটি হলো সেই চোখ, যা রাতের কোন অংশে আল্লাহ তায়ালার ভয়ে কাঁদে এবং দ্বিতীয়টি ঐ চোখ, যা আল্লাহ তায়ালার পথে পাহারা দিয়ে রাত অতিবাহিত করে। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস-১৬৪৫) ২. এক ব্যক্তি আরয করলো: ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমি কোন জিনিসের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে পারবো? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: নিজের চোখের অশ্রুর মাধ্যমে। কেননা, যে চোখ আল্লাহ তায়ালার ভয়ে কান্না করে, তাকে জাহান্নামের আগুন কখনো স্পর্শ করবে না। (আত তারগীব ওয়াত তারহিব, ৪/ ৯৮) ৩. তিন লোকের চোখ জাহান্নাম দেখবে না। একটি হলো ঐ চোখ, যা আল্লাহ তায়ালার পথে পাহারা দিলো, দ্বিতীয়টি হলো ঐ চোখ, যা আল্লাহ তায়ালার ভয়ে কান্না করে এবং তৃতীয়টি হলো ঐ চোখ, যা আল্লাহ তায়ালার হারামকৃত জিনিসের দিকে দেখা থেকে বিরত থাকে। (মু’জামুল কবীর, মুসনাদে বাহায বিন হাকীম, হাদীস-১০০৩)

হযরত সায়্যিদুনা আনাস বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি: হে লোকেরা! কান্না করো। যদি তোমাদের কান্না না আসে তবে কান্না করার চেষ্টা করে কান্না করো, কেননা দোযখীরা দোযখে কান্না করবে, এমনকি তাদের অশ্রু তাদের চেহারায় এমনভাবে বয়ে যাবে যে, যেন তা নদী, এক পর্যায়ে অশ্রু শেষ হয়ে যাবে অতঃপর তাদের রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে এবং সেই রক্ত এতই বেশি প্রবাহিত হবে যে, যদি এতে নৌকা চালানো হয় তবে নৌকা চলবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং- ৪১৯৬)

অন্তরে খোদাভীতি সৃষ্টির পাশাপাশি জান্নাতে যাওয়ার আমল সমূহের মধ্যে একটি আমল হলো মুসলমানের সম্মান ও সম্ভ্রমের হিফাযত করা। সুতরাং যদি আপনার সামনে কোন লোক কোন ইসলামী ভাইয়ের দোষ বা তার ভূলের আলোচনা তার উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে শুরু করে এবং শুনাতে যদি কোন শরীয়তের উপযুক্ত কারণ না থাকে তবে মুসলমানের সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আখিরাতে সাওয়াব অর্জনের নিয়্যতে নিজের ইসলামী ভাইয়ের সম্মানের হিফাযত করার ব্যবস্থা করুন। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: যে তার (মুসলমান) ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার সম্মানের নিরাপত্তা বিধান করে তবে আল্লাহ তায়ালার দয়াময় দ্বায়িত্ব যে, তিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দিবেন। (মওসুআতি লি ইবনে আবীদ দুনিয়া, হাদীস-২৪১) অন্যত্র নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: যে দুনিয়ায় তার ভাইয়ের সম্মানের হিফাযত করলো, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন এক ফিরিশতা প্রেরণ করবে, যে জাহান্নাম থেকে তাকে হিফাযত করবে। (মওসুআতি লি ইবনে আবীদ দুনিয়া, হাদীস-১০৫)

মনে রাখবেন! মুসলামনের গীবতকারীকে বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা থাকাবস্থায় বাঁধা দেয়া ওয়াজিব, বাঁধা দেয়া মহান সাওয়াব এবং বাঁধা না দেয়া যন্ত্রণাদায়ক আযাবের কারণ। এ প্রসঙ্গে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: যার সামনে তার মুসলমান ভাইয়ের গীবত করা হয় এবং সে তাকে সাহায্য করতে সক্ষম আর সাহায্য করে, আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে সাহায্য করবেন এবং যদি ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও সাহায্য না করে তবে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়া এবং আখিরাতে তাকে আটক করবেন। (মুসান্নিফে আব্দুর রাজ্জাক,হাদিস-২০৪২৬) অন্যত্র ইরশাদ করেন: যে ব্যক্তি নিজের ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার গীবতে বাঁধা দিলো (অর্থাৎ মুসলমানের গীবত করা হচ্ছিলো, সে বাঁধা দিলো) তবে আল্লাহ তায়ালার উপর হক হলো, তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেয়া। (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদীস-৪৯৮১) অতএব যখনই কোন মুসলমান সম্পর্কে বিরুপ (ঘঊএঅঞওঠঊ) আলোচনা শুরু হবে সাথেসাথেই সতর্ক হয়ে যাওয়া আবশ্যক এবং যদি সেই আলোচনা গীবত সম্বলিত বা গীবতের দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে সাথেসাথেই এর থেকে বিরত থাকতে হবে, যদি অন্য কোন ব্যক্তি এরূপ কথাবার্তা বলতে থাকে তবে তাকে সুন্দরভাবে বাঁধা প্রদান করতে হবে, যদি সে বিরত না হয় তবে সেখান থেকে উঠে যেতে হবে, যদি তাকে বাঁধা প্রদান করা বা সেখান থেকে সরে যাওয়া সম্ভব না হয় তবে মনে মনে ঘৃণা করতে হবে, সুন্দরভাবে কথা ঘুরিয়ে দিবে, সেই কথার প্রতি অনাগ্রহ দেখবে, যেমন; এদিক সেদিক দেখতে থাকবে, চেহারায় অসন্তুষ্টতার ভাব নিয়ে আসবে, বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করবে এবং সুযোগ পেতেই সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করবে।

আফসোস! মুসলমানদের অধিকাংশই বর্তমানে গীবতের ভয়ানক আপদে লিপ্ত। এর মূল কারণ হলো গীবত সম্পর্কে না জানা। একটি বিরাট অংশ রয়েছে, যারা গীবতের সংজ্ঞা সম্পর্কে জানেই না আর যখন কোন জিনিসের ব্যাপারে জানাই না থাকে তবে তা থেকে বাঁচা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। গীবত এমন একটি আপদ যে, এর থেকে খুবই কম সংখ্যক মুসলমান বাঁচতে পারে, আমাদের গীবত ও অন্যান্য গুনাহ থেকে বাঁচতে, অপরকে বাঁচাতে এবং গুনাহগারের গুনাহের বোঝা কমানোর চেষ্টা করা উচিৎ। অপরের বোঝা কমানোর একটি পদ্ধতি হলো যে, যতটুকু সম্ভব আমরা আমাদের হক সমূহ থেকে মুসলমানদেরকে ক্ষমা করে দেয়া। এর প্রতি উৎসাহ প্রদান করতে গিয়ে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: তোমাদের মধ্যে কেউ কি এই বিষয়ে অপারগ যে, সে আবু দমদম এর ন্যায় হবে। সাহাবাে কেরাম আরয করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আবু দমদম কে? নবীজি ইরশাদ করলেন: পূর্ববর্তী উম্মতের মধ্যে এক ব্যক্তি ছিলো, সে সকাল বেলা এরূপ বলতো: হে দয়ালূ আল্লাহ! আমি আজকের দিনে নিজের সম্মানকে ঐ ব্যক্তির প্রতি সদকা করে দিলাম, যে আমার প্রতি অত্যাচার করে। (শুয়াবুল ঈমান, হাদীস- ৮০৮২)

অন্যত্র রয়েছে, যে মানুষের প্রদত্ত কষ্টে ধৈর্যধারণ করলো, আল্লাহ তায়ালা তার থেকে জাহান্নাম এবং এর ধোঁয়ার কষ্টকে আটকে রাখবে এবং জাহান্নামের একটি দরজা হলো “বাবুত তাশাফফি”, তা দিয়ে সেই প্রবেশ করবে, যে তার রাগকে সংবরন করেনি। আর যে তার রাগকে সংবরন করলো এবং নিজের হক আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য ছেড়ে দিলো, যখন সে পুসিরাত দিয়ে গমন করবে তখন আল্লাহ তায়ালা তার জন্য সেই দরজা বন্ধ করে দিবেন এবং আল্লাহ তায়ালা তাকে কষ্ট প্রদানকারীর নেকীসমূহ তার আমল নামায় পরিবর্তন করে দিবেন আর তার গুনাহ সমূহ ঐ ব্যক্তির আমল নামায় পরিবর্তন করে দিবেন এবং আল্লাহ তায়ালা কতইনা উত্তম মিমাংসাকারী। (কুররাতুল উয়ুন ওয়া মাফরুহুল কুলুবুল মাহযুন, ৩৯৬ পৃ:)

নিজের হক ক্ষমা করে দেয়া এবং প্রতিশোধ না নিয়ে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে আত্মসমর্পন করে নেয়া নিঃসন্দেহেই হিম্মতের ব্যাপার। মনের মধ্যে উতলে উঠা প্রতিশোধের আগুনকে প্রশমিত করা নিঃসন্দেহে কষ্টকর। কিন্তু মনে রাখবেন! জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকা এবং জান্নাত অর্জন করাও এত সহজ নয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: জাহান্নাম কু-প্রবৃত্তির মধ্যে আবৃত (লুকায়িত) এবং জান্নাত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আবৃত। (সহিহ বুখারী, ৪/ ২৪৮৭)

প্রখ্যাত মুফাস্সীর হাকীমুল উম্মত মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আলোচ্য হাদীসের শব্দাবলী “জাহান্নাম কু-প্রবত্তির মধ্যে আবৃত” প্রসঙ্গে বলেন: দোযখ স্বয়ং খুবই ভয়ানক কিন্তু তার রাস্তায় অনেক নকল ফুল ও বাগান সজ্জিত আছে। দুনিয়াবী গুনাহ, কুকর্ম, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে খুবই চাকচিক্যময় দেখায়। আর এটাই জাহান্নামের রাস্তা। আর “জান্নাত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আবৃত” প্রসঙ্গে বলেন: জান্নাত হচ্ছে একটি অত্যন্ত সুপ্রশস্ত বাগান, কিন্তু এর রাস্তাটি কাটাযুক্ত। যা অতিক্রম করা নফসের জন্য খুবই কষ্টকর। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, জিহাদ, শাহাদাত জান্নাতেরই রাস্তা। ইবাদতে একাগ্রতা, কামভাব বর্জন বাস্তবেই (নফসের জন্য) কষ্টকর বিষয়। স্মরণ রাখুন! এখানে কামভাব দ্বারা উদ্দেশ্য হল হারাম কার্যাদি, যেমন; মদ্যপান, ব্যভিচার, ধোঁকাবাজি, গান-বাজনা উদ্দেশ্য। তাতে বৈধ কামভাব অন্তর্ভূক্ত নয়। কষ্ট দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ইবাদত সম্পাদনের কষ্ট সমূহ। সুতরাং তাতে আত্মহত্যা ও সম্পদ নষ্ট করা অন্তর্ভূক্ত নয়।(মিরাতুল মানাজীহ, ৭/৫)

মনে রাখবেন! নেকী করার সময় কষ্ট এবং প্রতিবন্ধকতা অবশ্যই আসে কিন্তু এই কষ্ট আখিরাতে আমাদের বাঁচার উপলক্ষ তৈরী করে থাকে। আর গুনাহে অর্জিত স্বাদ অস্থায়ী হয়ে থাকে, কিন্তু এই স্বাদ মিটে যাওয়ার পর আমাদের জন্য আখিরাতে ফেঁেস যাওয়ার পথ তৈরি হয়ে যায়। যেকোন নেক আমল আমাদের জন্য যতই কষ্টকর হোক না কেন, তা করে নেয়া উচিৎ। মনে রাখবেন! যখন আল্লাহ তায়ালা দয়া করেন তখন এভাবেই অজুহাত বানিয়ে নেন, কোন একটি আমলকে নিজের দরবারে কবুলিয়্যতের মর্যাদা দান করে দেন অতঃপর এই কারণেই নিজ বান্দার উপর রহমত বর্ষন করেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রদান করার পাশাপাশি জান্নাতের সুন্দর অট্টালিকা ও বাগান সমূহ দান করে দেন। এ প্রসঙ্গে হযরত সায়্যিদুনা আব্দুল্লাহ বিন সামুরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রয়েছে, তিনি বলেন: একবার রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিকট আসেন এবং ইরশাদ করেন: আজ রাতে আমি একটি আশ্চার্যজনক স্বপ্ন দেখেছি, এক লোকের জান কবয করার জন্য মালাকুল মউত আলাইহিস সালাম এলেন, কিন্তু তার পিতা-মাতার আনুগত্য সামনে এসে গেলো এবং সে বেঁচে গেলো। এক ব্যক্তির উপর কবরের আযাব এসে গেলো কিন্তু তার ওযু (এর নেকী) তাকে বাঁিচয়ে নিলো। এক ব্যক্তিকে শয়তান ঘিরে নিলো কিন্তু আল্লাহ তায়ালার যিকির (করার নেকী) তাকে বাঁিচয়ে নিলো। এক ব্যক্তিকে আযাবের ফিরিশতারা ঘিরে নিলো কিন্তু তাকে (তার) নামায বাঁিচয়ে নিলো। এক ব্যক্তিকে দেখলাম যে, প্রবল পিপাসার কারণে জিহ্বা বের হয়ে ছিলো এবং একটি হাউযে পানি পান করতে গেলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হলো, এমন সময় তার রোযা এসে গেলো এবং (এই নেকী) তাকে পিপাসা নিবারন করে দিলো। এক ব্যক্তিকে দেখলাম, তার সামনে-পেছনে, ডানে-বামে, উপরে-নিচে অন্ধকারই অন্ধকার এবং সে সেই অন্ধকারে চিন্তিত ও বিপর্যস্ত ছিলো তখন তার হজ্ব ও ওমরা এসে গেলো এবং (এর নেকী সমূহ) তাকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে পৌঁছে দিলো। এক ব্যক্তির শরীর এবং চেহারার দিকে আগুন অগ্রসর হচ্ছিলো এবং সে তার হাত দ্বারা বাচাঁনোর চেষ্টা করছিলো তখন তার সদকা এসে গেলো এবং তার সামনে ঢাল হয়ে গেলো আর তার মাথার উপর ছায়া প্রদান করলো। এক ব্যক্তিকে যাবানিয়্যারা (অর্থাৎ আযাবের বিশেষ ফিরিশতা) চারিদিক থেকে ঘিরে নিলো, কিন্তু তার নেকীর প্রতি আদেশ দেয়া এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করার নেকী এলো এবং তা তাকে বাচিঁয়ে নিলো আর রহমতের ফিরিশতাদের নিকট সমর্পন করে দিলো। এক ব্যক্তিকে দেখলাম, যে হাঁটুতে ভর করে বসে আছে কিন্তু তার এবং আল্লাহ তায়ালার মাঝখানে হিযাব (অর্থাৎ পর্দা) রয়েছে কিন্তু তার সৎ চরিত্র এলো এবং এই (নেকী) তাকে বাচিঁয়ে নিলো ও আল্লাহ তায়ালার সাথে মিলিয়ে দিলো। এক ব্যক্তি পুসিরাতে দাঁড়িয়ে ছিলো এবং গাছের ডালে ন্যায় কাঁপছিলো কিন্তু তার আল্লাহ তায়ালার প্রতি সুধারণা (অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার প্রতি এই ধারণা রাখা যে, তিনি দয়াই করবেন) এলো এবং (সেই নেকী) তাকে বাঁিচয়ে নিলো আর সে পুলসিরাত অতিμম করলো। এক ব্যক্তি পুলসিরাতে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে চলছিলো, এমন সময় তার আমার প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করার নেকী এসে গেলো এবং (এই নেকী) তাকে দাঁড় করিয়ে পুলসিরাত পাড় করিয়ে দিলো। আমার উম্মতের এক ব্যক্তি জান্নাতের দরজার নিকট পৌঁছলো তবে তা সব তার জন্য বন্ধ ছিলো, এমন সময় তার কালেমার সাক্ষ্য প্রদান করা এলো এবং তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে গেলো আর সে জান্নাতে প্রবেশ করলো। (আল কওলুল বদী, ২৬৫ পৃ:)

অনেক সময় ছোট ছোট নেকীও জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাতে স্থায়ী প্রশান্তি অর্জনের উপলক্ষ হয়ে যায়। সুতরাং আমাদের উচিৎ, বেশি বেশি নেক আমল করতে থাকা এবং যে লোকেরা নেকীতে লিপ্ত তারাও সাবধান থাকুন যে, শয়তান যেনো তাদের এই বিষয়ের উপর ভরসা করাতে সফল হয়ে না যায় যে, তুমি তো অনেক নেক আমল করে নিয়েছো, এবার ক্ষান্ত হও, তোমার এই নেকী সমূহ তোমাকে ক্ষমা করানো এবং তোমাকে জান্নাতের নেয়ামত অর্জনের জন্য যথেষ্ট।

যদি এমন কোন খেয়াল মনে আসে তবে তা সাথেসাথেই দূর করে দিতে হবে এবং আল্লাহ তায়ালার গোপন ব্যবস্থাপনার প্রতি সর্বদা ভীত থাকতে হবে। কেননা কেউ জানেনা যে, দয়ালূ আল্লাহ তায়ালার গোপন ব্যবস্থাপনা কার সম্পর্কে কেমন, কেউ তো তার সারা জীবন কুফরে অতিবাহিত করে কিন্তু মৃত্যুর সময় ঈমানের দৌলত দ্বারা ধন্য হয়ে যায় আর কেউ সারা জীবন নেকীর মাঝে অতিবাহিত করার পরও বিদায় মন্দভাবে হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ঈমানের উপর মৃত্যু দান করুক এবং মন্দ মৃত্যু থেকে হিফাজত করুক। আমীন ! বিজাহিন নবিয়্যিল আমীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

লেখক: আরবী প্রভাষক, তাজুশ শরীআহ মাদ্রাসা; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

ভারতের কাছে হারানো ২০০ একর জমি ফেরত পাচ্ছে বাংলাদেশ

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

যৌথ বাহিনীর অভিযানে ১৩দিনে ১৫৫ অস্ত্র উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৭২

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবীতে বালাগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিল

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সৌজন্য সাক্ষাৎ

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যশোরে ৪ দিনের বৃষ্টিপাতে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা, বিপর্যস্ত জনজীবন

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান টেকনাফ থেকে গ্রেপ্তার

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

৪ ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কমালো পাকিস্তান

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

তারাকান্দায় সাবেক এমপি শরীফসহ ৫৯ আ’লীগ নেতাকর্মীর নামে মামলা

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

শার্শায় বাবার কোদালের আঘাতে ছেলে নিহত

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

গোলাপগঞ্জে ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

কিশোরগঞ্জে ঈদে মিলাদুন্নবীর র‌্যালিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, মসজিদ-মাজার ভাঙচুর, নিহত- ১

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য হাবিব-বিপ্লব গংদের নির্দেশে পুলিশ নেতা সেজে বিভ্রান্ত করেছিলেন কনস্টেবল জয়

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা হলে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য জগতবাসী দেখতে পাবে -মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

যানজটের সমাধান খুঁজতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মহানবী (সঃ) এর আদর্শ অনুসরণ করা হলে কোন রাষ্ট্র প্রধানকে পালাতে হবেনা-মিলাদুন্নবী (সঃ) এর আলোচনা সভায় বক্তারা

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী

মসজিদ-মাদরাসা কমিটি থেকে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করতে হবে: আজিজুল হক ইসলামাবাদী