শিক্ষাক্ষেত্রে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহর অবদান
০৯ মে ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৯ মে ২০২৪, ১২:১৮ এএম

হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ছিলেন একজন বড় মাপের শিক্ষক, শিক্ষা সংস্কারক, শিক্ষা প্রশাসক এবং একই সঙ্গে সাধক। তিনি পূর্ব বাংলার খুলনায় জন্ম গ্রহণ করেন।তবে বেশিরভাগ লেখাপড়া করেছেন কলকাতায়।কলকাতার লন্ডন মিশন সোসাইটি স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ, ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবং চাকুরি জীবন শুরু করেন পূর্ব বাংলায় রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুলে সুপার নিমারারি টিচার হিসাবে। তারপর তিনি পূর্ব বাংলার নানা প্রান্তে শিক্ষা প্রশাসক হিসাবে অ্যাসিসটেন্ট ডিপিআই এবং ডিপিআই হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি বেশীর ভাগ কাজ করেছেন চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা এলাকায়। এসময় তিনি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। কত স্কুল যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সেটা হয়ত বলে শেষ করা যাবে না। কলেজ গড়বার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অপরিসীম। বিশেষ করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজ গড়বার সময়ে তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এই কলেজেই বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পড়াশুনা করেছেন। এই কলেজের বেকার হোস্টেলটিও গড়বার জন্য তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এবং সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো ভূমিকা রেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়।
ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়বার লক্ষ্যে যে নাথান কমিশন তৈরি হয়েছিল তার একটি সাব-কমিটির সদস্য ছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.)। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট তৈরি করার জন্য ৯ সদস্যের যে কমিটি করেছিলেন সেই কমিটিরও তিনি একজন সদস্য ছিলেন। তিনি আজীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজ করেছেন। এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি সিনেট সদস্য ছিলেন। সেই সমটায় পূর্ব বাংলার শিক্ষা ও অর্থনীতি অনেক অনগ্রসর ছিল। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অনগ্রসরতা ছিল প্রকট। এবং এই সময়টি তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে পূর্ব বাংলায় সত্যি সত্যি যদি উন্নয়ন করতে হয়, যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হয় তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। এজন্য পূর্ব বাংলায় অসংখ্য মাদ্রাসা, স্কুল, ও কলেজ গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম এবং শিক্ষাক্ষেত্রেও তিনি অনেকগুলো আমূল সংস্কারের সাথে যুক্ত ছিলেন। যেমন একসময় আই.এ, বি.এ ও এম.এ সকল পরীক্ষায় আগে নাম লেখা হত। নাম লেখা থাকলে হিন্দু ও মুসলিম বৈষম্য সৃষ্টি করার সুযোগ ছিল। সুতরাং তিনি প্রস্তাব করলেন পরীক্ষার খাতায় নাম থাকবে না। শুধু রোল নাম্বার থাকবে এবং এই সংস্কারটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক সংস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে পূর্ব বাংলার যে মধ্যবিত্ত, সেই মধ্যবিত্ত গড়ে তুলবার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯১১ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেল তখন এই পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ছিল।সেই ক্ষোভ নিরসনের জন্য ব্রিটিশরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। আরও ছিলেন নওয়াব আলী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও স্যার সলিমুল্লাহ। তাদের সাথে মিলে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বহুমাত্রিক কাজ করেছেন। আর আমরা তো জানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীকালে আমাদের জাতিসত্ত্বা, আমাদের ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির একটি কেন্দ্র বিন্দুতে রূপান্তরিত হয়েছিল। সুতরাং এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাদের স্বাধীনতার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি বড় ধরণের ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি শুধু শিক্ষা সংস্কারক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা-ই ছিলেন না। ছিলেন তিনি একজন ভালো লেখকও।অসংখ্য বই তিনি লিখেছেন এবং অন্যের অসংখ্য বইও প্রকাশ করেছেন তাঁর প্রকাশনী থেকে। তিনি মখদুমী লাইব্রেরীটি স্থাপন করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি তাঁর আহ্ছানউল্লা বুক হাউস লিমিটেড থেকে আমাদের দেশের অসংখ্য বিখ্যাত উপন্যাস যেমন আনোয়ারা, বিষাদ সিন্ধু, কাজী নজরুল ইসলামের জুলফিকার, বনগীতি, কাব্যে আমপারা; আবু জাফর শামসুদ্দীনের পরিত্যক্ত স্বামী তিনি প্রকাশ করেছিলেন। এসব বই প্রকাশ করে তিনি এই পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মানস গঠনে ও মুসলিম সাহিত্য চর্চায় আধুনিকতা এবং সমাজলগ্নতা আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
এই সময়টায় তিনি তার সুখ্যাত প্রতিষ্ঠান আহ্ছানিয়া মিশন তাঁর নিজ গ্রাম সাতক্ষীরার নলতায় শুরু করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন নামেও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। আমরা সবাই জানি প্রতিষ্ঠান খুব গুরুত্বপূর্ণ ।একলা মানুষ টুকরা মাত্র। কিন্তু অনেকে মিলে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি উন্নয়ন করা যায়। সেই বিচারে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।এখনও তা করে যাচ্ছে।
আমি গভর্নর হিসেবে যখন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সাথে জড়িত ছিলাম তখন দেখেছি আহ্ছানিয়া মিশনের ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাংক বড় ভূমিকা পালন করেছে। আমি তাদের উৎসাহিত করেছি। আমার জানা মতে খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ খুবই গুরুত্ব দিয়ে এই হাসপাতালটি গড়ে তোলার জন্য তার নিজের পূবালী ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করেছেন। এছাড়াও আহ্ছানিয়া মিশন সমাজের নানা ক্ষেত্রে বড় ধরনের কাজ করছে। সুতরাং এই শিক্ষাবিদ এই সংস্কারক খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের এই পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তদের মনে গেঁথে আছেন। সেই জন্য তিনি পুরস্কৃতও হয়েছেন । বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মরণোত্তর পুরস্কারে তিনি ভূষিত হন। তাছাড়া তাঁর প্রতিষ্ঠিত ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার অর্জন করে।
তাই তাঁকে বরাবরই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তিনি সেই সব জায়গায় কাজ করেছেন যেখানে কাজ করলে মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলা যায়। শিক্ষাই মানুষের মন ও মননের পরিবর্তন ঘটায়। শিক্ষা ও জীবন আলাদা হতে পারে না। সে কারনেই একটি মানবিক ও অর্থনীতি সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মানের জন্য তিনি সব সময় কাজ করেছেন শিক্ষা নিয়ে। শিক্ষার প্রসারে তিনি অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়বার জন্য তিনি নিরলস কাজ করেছেন। এই কারণে আমাদের এই পূর্ব বাংলায় তার যারা উত্তরসূরি তারা এখনো তাকে স্মরণ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে তার অবদানের জন্য এবং সংস্কারের জন্য। আমি জেনে খুব আনন্দিত যে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে ডিসেম্বর মাসব্যাপী খানবাহাদুর আহ্ছানুল্লাহর ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী পালন করছে। এই জন্মবার্ষিকী উদযাপনকে কেন্দ্র করে তাঁর অবদানগুলো সকলের সামনে নিয়ে আসতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

মতলব মুন্সীর হাট বাজারে আগুনে পুড়েছে ১৭ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

আর্টেমিস অ্যাকর্ডে যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশকে স্বাগত জানাল যুক্তরাষ্ট্র

দেশের চার অঞ্চলে দুপুরের মধ্যেই ঝড়ের শঙ্কা, নদীবন্দরগুলোকে সতর্ক বার্তা

সাগরে ডাকাতি: ২ কোটি টাকার মালপত্র লুট, ২৫ ঘণ্টা পর ৬৮ জেলে উদ্ধার

ইসরাইলি অবরোধে অপুষ্টিতে ভুগছে গাজার ৬০,০০০ শিশু : জাতিসংঘ

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গোপন ঢাকামুখী যাত্রা, গোয়েন্দা তথ্যে চাঞ্চল্য

ঢাকায় তাপমাত্রা কমার আভাস, শীতল দিনে স্বস্তির সম্ভাবনা

হঠাৎ বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, ভারতের উদ্দেশ্য কী ছিল?

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৯ জিএমকে ডিএমডি পদে পদোন্নতি

নোয়াখালীতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের দাবিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি ডিসি'র

ইসরায়েলের বর্বরতার প্রতিবাদে রাজধানীতে মোটরসাইকেল র্যালি

সৈয়দপুরে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতার বাড়ি থেকে বোমা সাদৃশ্য বস্তু উদ্ধার

বিনিয়োগকারীদের চোখ আগামী নির্বাচিত সরকারের দিকে: খসরু

ভারতজুড়ে ওয়াকফ আইন নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ ও আইনি লড়াই

ভক্ত, দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখোরিত মোরেলগঞ্জের লক্ষীখালি বারুনী স্নানোৎসব ও ধর্মীয় মাতুয়া মেলা

ইসরায়েলি অবরোধে ত্রাণহীন গাজায় মানবিক বিপর্যয়

ড. ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আনবে, প্রত্যাশা আমিরাত প্রেসিডেন্টের

নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ গেল দুই বোনের

জীবিত অভিবাসীদের ‘মৃত’ ঘোষণা করে তাড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন

বঙ্গোপসাগরে ৪ ট্রলারে ডাকাতি, গুলিবিদ্ধসহ আহত ৮